স্টিভ জব |
(পৃথিবীর
সর্বকালের সেরা উদ্যোক্তাদের তালিকায় স্টিভ জবসের নামটি একদম প্রথম দিকে থাকবে। তথ্য-প্রযুক্তি বিপ্লবের একজন স্বপ্নদ্রষ্টা হিসেবে তাঁর অবদান বিশ্ববাসী শ্রদ্ধার সাথে স্মরণ করবে সবসময়। আরেকটি কারণে অমর হয়ে থাকবেন তিনি চিরদিন। সেটি একটি অসামান্য বক্তৃতার জন্য। ২০০৫ সালে স্ট্যানফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাবর্তন অনুষ্ঠানে এ বক্তৃতা দেন
তিনি। পৃথিবীজুড়ে লাখো মানুষের হৃদয় ছুঁয়ে যাওয়া এ বক্তৃতাটি পাঠকদের
জন্য ভাবানুবাদ করা হলো।)
আজ
তোমাদের সামনে হাজির হতে পেরে বড় গৌরব হচ্ছে আমার! পৃথিবীর সবচেয়ে চমৎকার বিশ্ববিদ্যালয় গুলোর একটির ছাত্র তোমরা। মজার ব্যাপার
হলো আমি নিজে কখনো কলেজের পাটও চুকোতে পারিনি! আজ এই আনন্দের
দিনে কোন জ্ঞানগর্ভ বক্তৃতা দেওয়ার ইচ্ছা নেই আমার। কেবল তিনটা গল্প শেয়ার করতে চাই তোমাদের সাথে। আমার জীবনের তিনটি গল্প। ব্যাস, এটুকুই।
প্রথম গল্পটা হচ্ছে জীবনটাকে এক সুতোয় বাঁধা নিয়ে
আমি রীড কলেজে ভর্তি হওয়ার মাত্র ছয় মাসের মধ্যে ড্রপ আউট হয়ে যাই! কিন্তু দেখা গেল তারপর আরো প্রায় বছর দেড়েক সেখানে থেকে গেলাম সবকিছু ছেড়েছুড়ে চলে আসবার আগে। প্রশ্ন হচ্ছে, এত সাধের একটা কলেজ থেকে কেন ড্রপ আউট হলাম আমি?এই গল্পের শুরু আসলে আমার জন্মেরও আগে। আমার মা ছিলেন কলেজে পড়ুয়া কমবয়সী একটি মেয়ে। আমাকে লালন পালন করার মত অবস্থা তার ছিল না। তিনি ঠিক করলেন আমাকে কারো কাছে দত্তক দিয়ে দেবেন। মায়ের খুব ইচ্ছা ছিল আমার দত্তক পরিবার হবে উচ্চশিক্ষিত, নিদেনপক্ষে কলেজ গ্র্যাজুয়েট।
সেভাবেই সব ঠিকঠাক, এক আইনজীবী পরিবারের সাথে দফা হলো আমাকে দত্তক নেওয়ার। সমস্যা বাঁধলো ঠিক আমার জন্মের সময়। শেষ মুহূর্তে সেই দম্পতি ভেবে দেখলেন তারা আসলে একটা কন্যাশিশু চান! তখন ওয়েটিং লিস্ট থেকে ফোন গেল আরেক দম্পতির কাছে।
“আমাদের
কাছে একটি
ছেলেশিশু এসেছে।
আপনারা কি
তাকে দত্তক
নিতে আগ্রহী?”
“অবশ্যই!”
এভাবেই আমার
নতুন বাবা
মার কোলে
চলে গেলাম
আমি। কিন্তু
আমার
মা কিভাবে
যেন খবর
পেয়ে গেলেন
এই নতুন
বাবা মা
কেউই আসলে
কলেজের দোরগোড়া
পেরোন নি!
মা তো
রেগে কাঁই!
অবশেষে তাকে
বহুকষ্টে ঠান্ডা
করা গেলো
এই শর্তে
যে একদিন
আমাকে অবশ্যই
কলেজে পাঠানো
হবে!
আমার নতুন
বাবা মা
তাদের কথা
রাখলেন। সেদিনের
সেই ছোট্ট
আমি সতের
বছর পর
সত্যি সত্যি
কলেজে পা
রাখলাম! কিন্তু
বোকার মত
এত খরুচে
একটা কলেজ
বেছে নিলাম
যে বেচারী
বাবা মার
সারা জীবনের
সঞ্চয় জলের
মত খরচ
হতে লাগলো
আমার পিছনে!
এভাবে ছয়
মাস চলার
পর ভেবে
দেখলাম ভুল
সবই ভুল।
আমি যে
আসলে জীবনে
কি করতে
চাই সেটাই
ভেবে পাচ্ছি
না। কলেজের
পড়ালেখা বিরাট
যন্ত্রণা, এই
আপদ বয়ে
বেড়ানোর কোন
মানে দেখলাম
না। হুট
করে সিদ্ধান্ত
নিলাম ড্রপ
আউট হয়ে
যাই!
ঠান্ডা মাথায়
ভাবতে গেলে
নিজেকে বেকুব
মনে হওয়ার
কথা। কিন্তু
আমার কেন
যেন অনুভব
হলো একদম
ঠিক কাজ
করেছি! মন
যদি নাই
টেকে কেন
তবে ঝুলে
থেকে খামাখা
নিজেকে কষ্ট
দেওয়া?!
সুতরাং কয়দিন
পর দেখা
গেল আমি
মহানন্দে ক্লাস
করা ছেড়ে
দিয়ে ঘুরে
বেড়াচ্ছি ক্যাম্পাসে!
বিভিন্ন ডিপার্টমেন্টে
ঘুরাঘুরি করি,
যখন যেই
ক্লাস ইন্টারেস্টিং
লাগে সেখানে
ঢুঁ মেরে
আসি।
ব্যাপারটা
কাগজে কলমে
খুব বিপ্লবী
শোনাচ্ছে, কিন্তু
বাস্তবে রোমান্টিসিজমের
ছিঁটেফোঁটাও ছিল
না! যেহেতু
আমি আর
ছাত্র না,
সুতরাং কোন
রুম পেলাম
না। সারাদিন
দৌড়াদৌড়ি করে
রাতে বন্ধুদের
রুমের মেঝেতে
মরার মত
ঘুমাই। পকেটে
কোন পয়সা
নাই, কাউকে
কিছু বলতেও
পারি না
লজ্জায়। ক্ষিধেয়
চোখে অন্ধকার
দেখি। কোকের
বোতল কুড়িয়ে
ফেরত দিলে
পাঁচ সেন্ট
করে দেয়,
আমি এই
কাজ করে
খাওয়ার খরচ
জোটানো শুরু
দিলাম। প্রতি
রবিবার সাত
মাইল হেঁটে
হরে কৃষ্ণ
মন্দিরে যেতাম,
সেখানে মুফতে
বড় ভাল
খাবার মিলতো
সেদিন!
মজার ব্যাপার হলো এত দুঃখ কষ্টের মাঝেও আমার কোন আফসোস ছিল না। এই ভবঘুরে জীবন নিয়ে বেশ ছিলাম। যখন যেটাতে আগ্রহ পাই সেটা নিয়ে লেগে থাকি। ব্যাপারটা যে কত সুদূরপ্রসারী ছিল তার একটা ছোট্ট উদাহরণ দেই-কলেজে হঠাত একবার ক্যালিগ্রাফি কোর্স চালু হলো। ক্যাম্পাসের দেয়ালে দেয়ালে পোস্টারে, ড্রয়ারের লেবেল পর্যন্ত অসম্ভব সুন্দর ক্যালিগ্রাফি দিয়ে সাজানো। আমি বড় মুগ্ধ হলাম দেখে। যেহেতু কোন কাজ নেই, ভর্তি হলাম ক্যালিগ্রাফি কোর্সে। সারাদিন এটা নিয়েই পড়ে থাকি। টাইপোগ্রাফির যত খুঁটিনাটি, বিভিন্ন রকম ফন্ট, কালির ব্যবহার আরো কত কী শিখলাম। আমি বিজ্ঞানের মানুষ, শিল্পের এই প্রগাঢ় সৌন্দর্যের জগৎ আমাকে বিমোহিত করলো। শিল্পের প্রতি আমার জন্ম নিল গভীর আবেগ।
এই তুচ্ছ ক্যালিগ্রাফি কোর্স আমার জীবনে কোন কাজে লাগার কথা না। (যদি না আমি পোস্টারে লেখালেখির কাজ করে জীবন চালানোর কথা ভাবি!) কিন্তু বছর দশেক পর একটা দারুণ ব্যাপার ঘটলো! আমরা যখন প্রথম ম্যাক কম্পিউটার ডিজাইন করছিলাম, তখন আমার মনে ভীড় করলো সেই কলেজ জীবনে ক্লাস বাদ দিয়ে শেখা ক্যালিগ্রাফি কোর্সের কথা। দেখা গেল এতদিন পরেও কিছুই ভুলিনি, সব ঠিকঠাক মনে আছে! আমরা পরম মমতায় ম্যাক কম্পিউটারকে সাজালাম অসম্ভব সুন্দর সব টাইপোগ্রাফি দিয়ে।
একবার ভেবে দেখো তো, আমি যদি সেদিন ড্রপ আউট হয়ে এই ক্যালিগ্রাফি না শিখতাম, তাহলে ম্যাক কম্পিউটারে আগের খটোমটো ডিজাইনই থেকে যেতো। আর উইন্ডোজও যেহেতু আমাদের ডিজাইন চোখ বুঁজে মেরে দিয়েছে (!), সুতরাং বলাই যায়, সেদিনের সেই পাগলামিটা না করলে আজ পৃথিবীর কোথাও কম্পিউটারে এমন মন জুড়ানো টাইপোগ্রাফি হয়তো থাকতো না!
আমি যখন ক্যালিগ্রাফি শিখলাম, তখন কি আদৌ জানতাম আমার এই জ্ঞান একদিন পৃথিবী বদলে দেবে? এটাই হচ্ছে জীবনের আনন্দ। তুমি যখন কিছু শেখো, নতুন কিছু করো, ক্লাসের পড়ালেখার বাইরেও বিভিন্ন কাজে অংশ নাও, মনে হতে পারে এসব করে কী হবে?! কিন্তু দশ বছর পর যখন স্মৃতির পাতা উল্টাবে, তখন দেখবে এই টুকরো টুকরো পরিশ্রমগুলোর কি সুন্দর এক সুতোয় বাঁধুনি হয়েছে তোমার জীবনে! সুতরাং তুমি যাই কিছু করো না কেন, বিশ্বাস রেখো সবসময় নিজের উপর। একদিন তারায় তারায় রটিয়ে দেবে তোমার গল্প, এই অসম্ভব দৃঢ় বিশ্বাসটাই দেখবে বদলে দেবে জীবন চিরদিনের জন্য!
আমার দ্বিতীয় গল্পটা ভালবাসা নিয়ে। ভালবাসবার এবং হারাবার।
নেশা আর পেশা যার মিলে যায় সে বড় ভাগ্যবান। আমি খুব কম বয়সেই আমার ভালবাসার জায়গাটা খুঁজে পেয়েছিলাম। ওজ এবং আমি যখন বাসার গ্যারেজে অ্যাপলের যাত্রা শুরু দিলাম তখন আমার বয়স মাত্র বিশ! রাতদিন উন্মাদের মত খাটতাম আমরা। দেখা গেল মাত্র দশ বছরের মাথায় সেই গ্যারেজের ঘুঁপচিতে জন্ম নেওয়া অ্যাপল এখন দুই বিলিয়ন ডলারের বিশাল এক প্রতিষ্ঠান হয়ে দাঁড়িয়েছে, যেখানে চার হাজারেরও বেশি মানুষ কাজ করে! আমার তিরিশতম জন্মদিনের কয়দিন পরই বাজারে আসলো অ্যাপলের কালজয়ী উদ্ভাবন- দ্যা ম্যাকিন্টশ।
এবং তারপর
পরই আমাকে
অ্যাপল থেকে
বের করে
দেওয়া হলো!
কি আজব
কান্ড! নিজের
হাতে তৈরি
করা একটা
প্রতিষ্ঠান থেকে
কিভাবে কেউ
তোমাকে বের
করে দেয়?
ঘটনা হচ্ছে
অ্যাপল যখন
বড় হতে
লাগলো, তখন
এই বিপুল
কাজের চাপ সামলানোর জন্য আমরা
একজন চৌকস
লোককে এনেছিলাম।
কয়দিন পর
দেখা গেল
তার সাথে
আমার চিন্তাভাবনা
মিলছে না।
অ্যাপলের ভবিষ্যৎ
নিয়ে তার
আর আমার
পরিকল্পনায় আকাশ-পাতাল
ফারাক! তখন
দুজনের মাঝে
বেশ ধুন্ধুমার
কান্ড বেঁধে
গেল, এবং
অ্যাপলের পরিচালনা
পর্ষদের সবাই
গম্ভীর মুখে
জানিয়ে দিলো
তাদের সমর্থন
ওর সাথেই
আছে! সুতরাং
মাত্র তিরিশ
বছর বয়সে
আমাকে নিজের
হাতে তিল
তিল করে
গড়ে তোলা
কোম্পানি থেকে
রীতিমত ঢাকঢোল
বাজিয়ে বের
করে দেওয়া
হলো! সারা
জীবনের ভালবাসা
আর সাধনা
এক ফুঁৎকারে
উড়ে গেল
বাতাসে। আমার
বুকের ভেতরটা
দুমড়ে মুচড়ে
গেল কষ্টে।
এরপর বেশ
কিছুদিন আমি
দিশেহারার মত
ঘুরে বেড়ালাম।
ভেতরটা একদম
এলোমেলো লাগছিলো।
একবার ভাবলাম
সব ছেড়েছুড়ে
নিরুদ্দেশ হয়ে
যাই! কিন্তু
এত দুঃখের
মাঝেও একটা
জিনিস অনুভব
করলাম- আমার
ভালবাসাটা হারিয়ে
যায়নি!
অ্যাপল থেকে
অপমানিত হয়ে
বেরিয়ে আসতে
হয়েছে আমাকে,
সবার কাছে
ব্যর্থতার প্রতীক
এই স্টিভ
জবস, কিন্তু
তাতে আমার
ভালবাসার নক্ষত্র
এতটুকু ম্লান
হয়নি! আমি
ঠিক করলাম
সবকিছু নতুন
করে শুরু
করবো।
প্রকৃতির
এই এক
লীলাখেলা। অ্যাপল
থেকে ছাঁটাই
হওয়ার পর
আমার মনে
হচ্ছিল লজ্জায়
মাটিতে মিশে
যাই! কিন্তু
পিছন ফিরে
তাকালে মনে
হয়- আরে!
এর থেকে
চমৎকার আর
কিইবা হতে
পারতো জীবনে!
সাফল্যের একটা
বিশাল ভার
আছে। হাজারো
প্রত্যাশা আর
দম্ভ বুকের
মাঝে পাথর
হয়ে চেপে
বসে। সবসময়
একটা গন্ডির
ভিতর চলতে
হয়, চাইলেই
যা ইচ্ছা
করা যায়
না। কিন্তু
আমি যেহেতু
সবকিছু একদম
নতুন করে
শুরু করছি,
আমার এরকম
কোন ঝামেলা
নেই! যা
ইচ্ছা, যেমন
খুশি তেমন
চলার আনন্দে
বিভোর আমি
প্রত্যাশার শিকল
ভেঙ্গে ডুব
দিলাম সৃজনশীলতার
এক অপূর্ব
জগতে!
পরের পাঁচ
বছরে আমি
“নেক্সট” নামে
একটা কোম্পানি
খুললাম। তারপর
“পিক্সার” নামে
আরো একটা,
এবং প্রেমে
পড়লাম অসাধারণ
এক রমণীর,
বিয়ে করে
ফেললাম দুজনে!
এই পিক্সার
থেকেই আমরা
বের করলাম
পৃথিবীর প্রথম
কম্পিউটার এনিমেটেড
ফিল্ম “টয়
স্টোরি”।
এখন তো
পিক্সার পৃথিবীর
সবচেয়ে সফল
এনিমেশন স্টুডিও!
এইসময় দারুণ
চমকপ্রদ এক
কাহিনী ঘটলো!অ্যাপল
নেক্সটকে কিনে
নিলো আমি
আবারও ফিরে
আসলাম প্রাণের
প্রতিষ্ঠানে! নেক্সটে
আমরা যেই
প্রযুক্তি উদ্ভাবন
করেছিলাম সেটার
উপর ভিত্তি
করেই অ্যাপলের
আজ এই
জয়জয়কার। লরেন
আর আমি
দুজনে গড়ে
তুললাম দারুণ
সুখী একটি
পরিবার।
আমি বুকে
হাত দিয়ে
বলতে পারি
সেদিন অ্যাপল
থেকে ছাঁটাই
না হলে
এই অসাধারণ
ব্যাপারগুলো ঘটতোই
না আমার
জীবনে! এটাই
তো জীবনের
আনন্দ, মাঝেমধ্যে
এমন সব
ঘটনা ঘটবে
যে মাথায়
আকাশ ভেঙে
পড়বে তোমার।
কিন্তু হাল
না ছাড়লেই
দেখবে সবকিছু
নতুন করে
আরো সুন্দর
হয়ে উঠছে!
জীবনের রংধনু
আরো বর্ণিল
হয়ে দেখা
দিচ্ছে তোমার
কাছে!
অনিবার্য মৃত্যু আমাকে গ্রাস করতে এসেছিলো, অথচ কি অবাক বিস্ময়ে বেঁচে রইলাম আমি
ভালবাসার
জায়গাটি খুঁজে
পাওয়ার চেয়ে
সুন্দর আর
কিছু হয়না।
জীবনের নেশাই
হয়ে উঠুক
পেশা। ম্যাড়ম্যাড়ে
ছাপোষা একটা
জীবন কাটানোর
কোন মানে
হয়? জীবন
এত সস্তা
না। তোমার
মাঝে যেই
ছাইচাপা বারুদ
আছে, সেটাকে
বের করে
আনো। জ্বালিয়ে
দাও পৃথিবী
ভালবাসার উচ্ছ্বাসে।
মহৎ কিছু
করো, পৃথিবীর
যে বড়
প্রয়োজন তোমাকে।
জগৎটাকে
ঘুরে দেখো,
উপলব্ধি করো
জীবনের মানে।
দেখবে, আপনা
থেকেই অনুভব
করবে কোন
কিছুর প্রতি
একটা তীব্র
আবেগ। যে
স্বপ্নের তাড়নায়
ছুটে চলা
যায় হাজার
বছর অটল
পরিশ্রমে।
কাজের মধ্যেই
ভালবাসা, কাজের
মধ্যেই জীবন।
জীবন্মৃতের মতো
বেঁচে থাকার
প্রশ্নই উঠে
না। তোমার
ভালবাসার নক্ষত্রটি
খুঁজে বের
করো। হাল
ছেড়ো না।
কক্ষনো না।
আমার তৃতীয় গল্পটা মৃত্যু নিয়ে।
আমার বয়স যখন সতের, তখন কোথায় যেন পড়েছিলাম- “যদি প্রত্যেকদিন এমনভাবে কাটাও যেন আজই তোমার জীবনের শেষ দিন, একদিন না একদিন ব্যাপারটা সত্যি হবেই!” এই উক্তিটি আমাকে গভীরভাবে অভিভূত করলো। আমি বিগত তেত্রিশ বছর প্রতিদিন সকালে আয়নার দিকে তাকিয়ে নিজেকে বলি, “তুমি আজ যা যা করবে প্ল্যান করেছ, আজ যদি তোমার জীবনের শেষ দিন হতো তবুও কি তাই করতে?”যদি দেখি যে বেশ কয়দিন হয়ে যাচ্ছে আমি উত্তরে নিজেকে “হ্যা” বলতে পারছি না, বুঝতাম একটা কিছু পরিবর্তন করা দরকার শীঘ্রই!
“মরে তো একদিন যাবোই!” এই কথাটা মাথায় থাকলে জীবনের কঠিন সিদ্ধান্তগুলো নেওয়াও একদম জলের মত সহজ হয়ে যায়। জীবনটাকে আসলে আমরা অনেক জটিল করে তুলি। মৃত্যু তো একদিন আসবেই! চারপাশের মানুষের প্রত্যাশা, গর্ব, হেরে যাওয়ার ভয়- এই জঞ্জালগুলো আমাদের মাথায় বোঝা হয়ে চেপে বসে। অথচ এগুলো কত তুচ্ছ একেকটা বিষয়! একশ বছর পর কেউ মনে রাখবে না তুমি ক্লাস নাইনে একটা পরীক্ষায় খারাপ করেছিলে!
মৃত্যু আছে বলেই জীবনটাকে আমি অনেক সহজভাবে নিতে পারি। পৃথিবীতে এসেছিলাম একদম নগ্ন হয়ে। ফিরেও যেতে হবে তেমনি খালি হাতে। হারানোর কিছুই নেই আমাদের। তাহলে কেন খামাখা মানুষের প্রত্যাশার চাপ বয়ে বেড়ানো? তোমার হৃদয় যা বলে, মন যা চায়, সেটাই তো সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ!
বছরখানেক আগে আমার ক্যান্সার ধরা পড়লো। ডাক্তার থমথমে মুখে জানালেন, আমার ক্যান্সারটা সেরে যাবার সম্ভাবনা খুব কম। মাস ছয়েক বেঁচে থাকতে পারলে সেটাই হবে পরম পাওয়া! স্ক্যানে দেখা গেল আমার প্যানক্রিয়াস একটা টিউমার ধরা পড়েছে। প্যানক্রিয়াস কি জিনিস সেটাই আমি জানি না!
ডাক্তার বললেন বাসার গিয়ে বিশ্রাম নিতে। পরিবারের সাথে সময় কাটাতে। সবকিছু গোছগাছ করে নিতে।
আমি বুঝলাম বিদায়ের ঘন্টা বেজে গেছে। আমার বাচ্চাগুলো কি সুন্দর প্রাণবন্ত, ওদের হাসি দেখলেই মন জুড়িয়ে যায়! তাদেরকে আমি কিভাবে বলবো, বাবা কিন্তু আর বেশিদিন নেই তোমাদের কোলে নিতে? আমার বুকটা ভেঙে গেল।
আমি সারাদিন ডায়াগনোসিস এর কাগজটা হাতে নিয়ে বসে থাকলাম। সন্ধ্যায় আরেকটা বায়োপসি করানো হলো, আমার গলার ভেতর এন্ডোস্কোপ ঢুকিয়ে সেই টিউমারের কিছু কোষ নিলেন তারা। পরীক্ষা নিরীক্ষা শেষে যখন ফলাফলের পালা আমার স্ত্রী দেখলেন ডাক্তারের চোখ অশ্রুসিক্ত! তিনি ডুকরে উঠে জানালেন, আমি অসম্ভব সৌভাগ্যবান একজন মানুষ! আমার ক্যান্সারটা খুব বিরল পর্যায়ের, যেটা অস্ত্রোপচার করে সারানো সম্ভব!
আমি সেই
অস্ত্রোপচারটা করালাম
এবং এখন
আমি একদম
সুস্থ একজন
মানুষ!
মৃত্যুকে
এত কাছে
থেকে আমি
আর কখনো
দেখিনি। অনিবার্য
মৃত্যু আমাকে
গ্রাস করতে
এসেছিলো, অথচ
কি অবাক
বিস্ময়ে বেঁচে
রইলাম আমি!
এই অভিজ্ঞতার
পর মৃত্যু
নিয়ে আমার
এক গভীর
উপলব্ধি হলো।
মরতে চায়
না কেউ
এ সুন্দর
ভুবনে। যে
মানুষটা স্বর্গে
যাবার স্বপ্নে
বিভোর সেও
কিন্তু মারা
যেতে চায়না
এতো তাড়াতাড়ি!
তবুও মৃত্যু
আমাদের সবার
শেষ গন্তব্য।
আমার মনে
হয় কি,
প্রকৃতির সবচেয়ে
চমৎকার উদ্ভাবন
এই মৃত্যু!
প্রকৃতি একঘেয়েমি
পছন্দ করে
না। সে
পুরনোদের সরিয়ে
দেয় নতুনের
আবাহনে।
আজ পৃথিবী
তোমাদের, সামনে
প্রাণচাঞ্চল্যে ভরপুর
উজ্জ্বল ভবিষ্যৎ।
কিন্তু দেখতে
দেখতে একদিন
তোমরাও বুড়িয়ে
যাবে, প্রকৃতি
মুছে দেবে
তোমাদের কোলাহল।
ব্যাপারটা যদিও
খুব নাটকীয়
শোনাচ্ছে, কিন্তু
এটাই যে
বাস্তবতা!
আমাদের জীবনটা
কত ছোট,
কত মূল্যবান!
সারা পৃথিবী
ঘেঁটে তোমার
মত ঠিক
আরেকটা তুমি
কোথাও পাওয়া
যাবে না!
এই জীবনটা
অন্যদের মত
হতে চেয়ে
কেন নষ্ট
করবে! লোকে
কি বললো,
কি ভাবলো
সেটা নিয়ে
ভাবার কোন
মানে হয়?
এই যে
তোমার বুকের
ভেতর একটা
স্বপ্নের বীজ,
সেটাকে বাড়তে
দাও। ডালপালা
মেলতে দাও।
ছড়িয়ে দাও
তোমার স্বপ্ন!
বিশ্বাস
করো, তোমার
ভেতরের স্বপ্নটাকে
অনুসরণ করে
কখনো ঠকবে
না। সে
কিভাবে যেন
সবসময় আগে
থেকেই জানে
আমাদের জন্য
কোনটা সবচেয়ে
ভাল! সেই
তোমাকে পথ
দেখাবে অন্ধকারে।
উড়িয়ে দেবে
বিজয়ের নিশান।
আমাদের
ছোটবেলায় খুব চমৎকার একটা প্রকাশনা ছিলো “The Whole Earth
Catalog” নামে। আমাদের প্রজন্মের কাছে সেটা ধর্মগ্রন্থের চেয়ে কিছু কম ছিলো না!
স্টুয়ার্ট ব্র্যান্ড নামে এক অসাধারণ মানুষ
ছিলেন এই পত্রিকার প্রাণপুরুষ।
তিনি পরম মমতায় পত্রিকাটিকে গড়ে তুলেছিলেন অসাধারণ কাব্যিক ছোঁয়ায়। ষাটের দশকের সেই সময় কম্পিউটারের সুবিধা ছিল না। তাই পোলারয়েড ক্যামেরায় ছবি তুলে, হাতে কাঁচিতে কেটে, টাইপরাইটারে লিখে মহা ধকলের মধ্য দিয়ে ছাপাতে হতো একেকটা প্রকাশনা! অনেক মানুষের ঘাম ঝরানো পরিশ্রমে সেটা হয়ে উঠতো অনন্য। এখন তোমাদের কাছে গুগল যেমন, সেই পঁয়ত্রিশ বছর আগে আমাদের কাছে পত্রিকাটা ছিল অনেকটা তেমনি। কি অপুর্ব জীবনবোধ,
আনন্দ আর জ্ঞানের মিশেল
ছিল পত্রিকাটির পাতায় পাতায়!
স্টুয়ার্ট
আর তার
দল নিরলস
নিষ্ঠা আর
সাধনায় অনেকগুলো
সংখ্যা বের
করলেন প্রকাশনাটির।
তারপর যখন
বিদায়ের পালা
আসলো, তারা
সবটুকু আবেগ
ঢেলে প্রকাশ
করলেন “The Whole Earth Catalog”, শেষবারের
মতো। সময়টা
ছিল সত্তরের
দশকের মাঝামাঝি।
আমার বয়স
তখন তোমাদের
মতোই। আমি
ছলছল চোখে
স্টুয়ার্ট আর
তার দলের
সেই শেষ
সংখ্যাটি হাতে
নিলাম। পিছনের
কভারজুড়ে একটা
ছবি। খুব
সুন্দর
একটি গ্রামের
মেঠোপথ। সকালের
সূর্যের ঝলমলে
রোদ। চারপাশের
গাছপালা চোখজুড়ানো
সবুজে ঘিরে
রেখেছে। তার
মাঝ দিয়ে
পথটা চলে
গেছে বহুদূর।
মিশে গেছে
দিগন্তে।
তার নিচে
লেখা, “ক্ষুধার্ত
থেকো। বোকা
থেকো।”
এটা ছিলো
বিদায়বেলায় তাদের
শেষ উপহার
আমাদের জন্য।
আমি সারাজীবন
এই কথাটি
গভীর আবেগে
মনে রেখেছি।
সবসময় চেয়ে
এসেছি তেমনটাই
যেন থাকতে
পারি চিরদিন।
আজ আমার
পালা ফুরোল।
তোমাদের সামনে
এক নতুন
দিগন্ত। এগিয়ে
যাও নবীন
প্রাণের উচ্ছ্বাসে।
তোমাদের কাছে
আমার শুধু
একটাই চাওয়া।
ক্ষুধার্ত থেকো। বোকা থেকো।
0 মন্তব্যসমূহ