Study SMART, not HARD: পড়াশোনা হবে আরো সহজ

আমাদের বন্ধুমহলে এমন কিছু বন্ধু আছে যারা প্রচুর পড়াশোনা করার পরও কাঙ্ক্ষিত ফলাফল অর্জনে সমর্থ হয় না। আবার এমনও অনেকে আছে যে কি না সেই অনেক পড়ুয়া বন্ধুটির মতো অত না পড়া সত্ত্বেও বেশ ভালো একটা রেজাল্ট করে বসে। সেই স্বল্প পড়ুয়া ভালো রেজাল্টধারী বন্ধুটির চমকপ্রদ ফলাফলের রহস্য জানতে কৌতূহল হয় আমাদের সবারই! রহস্যটা খুব সাধারণ। সারাদিন মনোযোগ ছাড়া পড়ার চাইতে ৩ ঘণ্টা মনোযোগ সহকারে পড়া শ্রেয়। কিন্তু, মনোযোগটাকে বেঁধে রাখার উপায়টা কী? 
চলো তবে জেনে নেওয়া যাক পড়াশোনা করার সময় মনোযোগ ধরে রাখার এবং যেকোনো কিছু ভালোভাবে শেখার ১৪টি দারুণ কৌশল সম্পর্কে।
১) মনে রাখার সুবিধার্থে নিমোনিক হোক ভরসা – 
শৈশবে আমাদের অনেকের কাছে এক প্রকার আতংক ছিলো ‘সরল’ নামের বৃহদাকার অংকগুলো। নামে সরল হলেও এটাকে শেষ পর্যন্ত মেলাতে গিয়ে রীতিমতো ঘাম বেরিয়ে যেতো আমাদের অনেকের। এরপরই স্কুলে শেখানো হলো সেই যুগান্তকারী মনে রাখার অস্ত্র “BODMAS” যেটা কিনা সরলের জটিলতাকে বুড়ো আঙ্গুল দেখিয়ে দিলো। এই “BODMAS” হলো নিমোনিক-এর প্রকৃষ্ট উদাহরণ। নিমোনিক-এর আরো একটা বেশ পরিচিত উদাহরণ দিতে গেলেবলতে হবে সেই পরিমাপের একক মনে রাখার জন্যে একদম ছোট্ট বেলায় শেখা চিরপরিচিত বাক্য-
কিলায়ে হাকায়ে ডাকাত মারিলে দেশে শান্তি মিলিবে। 
SMART ও একটি চমৎকার নিমোনিকের উদাহরণ। আমরা প্রায়ই বলে থাকি SMART Goal Setting এর কথা। এই SMART প্রকৃত অর্থে একটা Acronym. চলো দেখে নেই SMART শব্দের অক্ষরগুলো আসলে কী কী নির্দেশ করে।
S = Specific
M = Measurable
A = Attainable
R = Realistic
T = Time Bound
এরকম মজার মজার নিমোনিক তৈরি করে সহজেই মনে রাখা সম্ভব হবে ইংরেজির আতংক ভোকাবুলারি, পদার্থবিদ্যা বা গণিতের যেকোনো কঠিন আর হিজিবিজি সূত্র কিংবা রসায়নের নিরস আর তিতকুটে তত্ত্ব বা বিক্রিয়া।
২) পড়ার সময় মোবাইলকে ‘না’ বলো- 
এখনকার এই প্রজন্ম মোবাইল ছাড়া একটা মুহূর্ত কল্পনা করতেও ভয় পায়। কিন্তু পড়াশোনার সময় এই মোবাইল হলো সবচেয়ে বড় মনোযোগ বিনষ্টকারী। তাই পড়ার সময়টায় মোবাইলকে না বলতে হবে। যদিও মোবাইল থেকে দূরে থাকা চাট্টিখানি কথা নয়, আজ তিনটা ছোট্ট হ্যাক শিখিয়ে দিতে চাই যেগুলো তোমাকে পড়ার সময় মোবাইল থেকে দূরে রাখবে।
  • পড়তে বসো বিকেল বেলায় কিংবা এমন একটা সময়ে যে সময়টায় মানুষ সাধারণত অনলাইনে থাকে না।
  • মোবাইলটাকে রাখো হাতের নাগালের বাইরে। অর্থাৎ এমন একটা জায়গায় যাতে করে হাত বাড়ালেই না পাওয়া যায়। জায়গা থেকে উঠে গিয়ে আনতে হবে এমন জায়গায় রেখে তবেই পড়তে বসো।
  • পড়ার ফাঁকের বিরতিটাকে বিচক্ষণতার সাথে কাজে লাগাও। আমরা পড়ার ফাঁকে বিরতি নিলে সাধারণত সবার আগে সেই মোবাইলটাকেই হাতে নিই। এই জিনিসটা করা যাবে না।
এই ট্রিক তিনটাকে কাজে লাগিয়ে পড়ার সময় দূরে থাকো মোবাইল থেকে। 
৩) স্মৃতিশক্তি স্পেসড রিপিটেশন টেকনিক ব্যবহার করো – 
‘পড়া – পড়া – পড়া’ নাকি ‘পড়া – বিরতি/ঘুম – পড়া’ 
একটানা পড়ে যাওয়ার চাইতে মাঝখানে বিরতি নিয়ে পড়লে সেই পড়া স্মৃতিতে অধিকতর স্থায়ী হয়। পড়ার মাঝখানে বিরতি নিয়ে পুনরায় পড়ার যে প্রক্রিয়া এর নামই স্পেসড রিপিটেশন সিস্টেম। পড়া ভুলে যাওয়ার ঝুঁকি হ্রাস করতে এই ট্রিকটি কাজে লাগানো যেতেই পারে। আর বিরতিতে একটুখানি ঘুম স্মৃতিতে পড়ার স্থায়িত্ব বাড়াবে কয়েকগুণ। তাই, ঘুমের ব্যাপারটা ভুলে গেলে চলবে না।
৪) পড়ার জন্য একটা জায়গা নির্ধারণ করে ফেলো –  
পড়ায় মনোযোগ ধরে রাখতে কোথায় পড়া হচ্ছে সেই জায়গাটা বেশ গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে। সেটা হতে পারে তোমার বাসার একটা কোলাহলহীন, নির্জন আর পরিচ্ছন্ন জায়গায় রাখা তোমার পড়ার টেবিলটা কিংবা জানালার পাশে রাখা বিছানায়! জায়গাটা এমন হতে হবে যেখানে তুমি যেতে অভ্যস্ত যাতে করে সেখানে যাওয়া মাত্রই মনোযোগ চলে আসে।
তাই, পড়ার জন্যে চমৎকার একটা জায়গা নির্ধারণ করে ফেলো আজই।
৫) নিজে শিখে অন্যকে শেখাও – 
If you can’t explain it simply, you don’t understand it well enough.” -Albert Einstein
অর্থাৎ, কেউ কিছু শেখার পর পর সেটা যদি অন্যকে শেখাতে ব্যর্থ হয় তাহলে সে শেখায় ঘাটতি রয়েছে! তাই এখন থেকে নিজে নতুন যাই শেখো না কেন সেটা অন্যকে শেখানোর চেষ্টা করবে। তাহলেই সে শেখা অধিকতর স্থায়ী হবে।
৬) পর্যাপ্ত পানি পানের অভ্যাস করতে হবে – 
পানির অপর নাম জীবন!
সেই ছোট্টবেলা থেকে শুনে আসছি। আর “বেশি বেশি পানি খেতে হবে।” – হলো খুব সাধারণ আর পরিচিত এক উপদেশ। মনোযোগ স্থির রাখতেও এই পানির ভূমিকা বেশ গুরুত্বপূর্ণ। প্রতিবার পড়তে বসার আগে এক গ্লাস পানি পান করে বসা গেলে আমাদের মস্তিষ্কের কার্যক্ষমতা অনেকখানি বেড়ে যায়। এটা বৈজ্ঞানিকভাবে প্রমাণিত তথ্য।
৭) Sticky Notes, Marker Pens ও Highlighters ব্যবহারে শেষ মুহূর্তের প্রস্তুতি হবে দুর্দান্ত – 
পড়তে গিয়ে যখনই কোনো গুরুত্বপূর্ণ শব্দ, বাক্য বা তথ্য চোখে পড়বে সবসময় সেটাকে হাইলাইটার বা অন্য রঙয়ের কালি দিয়ে চিহ্নিত করে রাখলে রিভিশনের সময় কাজে দেবে। নতুন কোনো গুরুত্বপূর্ণ তথ্য সংযুক্ত করতে হলে স্টিকি নোটে লিখে বই কিংবা নোটে যুক্ত করে দেওয়া যেতে পারে। তথ্যের পরিমাণ বেশি হলে প্রয়োজনে অন্য রঙয়ের কলম দিয়ে বইতে বা নোটে লিখেও রাখা যেতে পারে। এই স্টিকি নোটস, হাইলাইটেড পয়েন্টস আর অন্য কালিতে লেখা গুরুত্বপূর্ণ পয়েন্টগুলোই রিভিশনের সময় চোখে পড়বে সবার আগে। এতে করে পরীক্ষার ঠিক আগমুহূর্তে রিভিশন দেওয়া সহজ হবে।
৮) শেখার বাস্তবিক প্রয়োগে বাড়বে দক্ষতা –
যখন যাই শেখো না কেন সেটাকে বাস্তবে ব্যবহারিক প্রয়োগ করার চেষ্টা করতে হবে। এতে করে জ্ঞান আর দক্ষতা দু’টোই বাড়বে। কোনো নতুন বই পড়লে বা মুভি দেখলে চেষ্টা করবে সেগুলোর রিভিউ লিখতে। সেগুলো থেকে নিজে কী বুঝলে বা শিখলে সেটা সবাইকে বোঝানোর ক্ষমতা থাকতে হবে। কোনো সফটওয়্যার স্কিল শিখলে সেটাকে কাজে লাগাতে হবে ব্যবহারিকভাবে। শিখতে হবে কী করে শিখতে আর কী করে নিজের শেখা জিনিস অন্যকে শেখাতে হয়।
৯) গাইতে গাইতে গায়েন –
যেকোনো জিনিস মনে রাখা কিংবা যেকোনো বিষয়ে দক্ষতা বাড়ানোর জন্যে সবচাইতে কার্যকরী উপায় হলো অনুশীলন বা চর্চা। যাই শেখা হোক না কেন সেটা প্রতিনিয়ত অনুশীলন করতে হবে, যাচাই করতে হবে দক্ষতাগুলো। এখন যাচাই করার উপায় হিসেবে কাজে লাগাতে পারো টেন মিনিট স্কুল (www.10minuteschool.com) এর কুইজগুলোকে। কুইজ দেওয়ার সাথে সাথে মিলবে রেজাল্ট, জানতে পারবে অন্যদের তুলনায় তোমার প্রস্তুতি ঠিক কোন অবস্থানে সেটাও।
তাই, এখন থেকেই যেকোনো ক্লাসের যেকোনো বিষয়ের যে টপিকই পড়া হোক না কেন কুইজ দিয়ে যাচাই করো তোমার দক্ষতা! 
১০) সময়সীমা আর লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করে পড়ার অভ্যাস করতে হবে –
“Procrastination” এই প্রজন্মের সবচেয়ে বড় সমস্যাগুলোর একটা। অনেক সময় দেওয়া হলেও আমাদের অধিকাংশই পড়তে বসবে সেই পরীক্ষার আগের রাতেই। ৬ মাস সময়ব্যাপী করতে দেওয়া রিসার্চের রিপোর্ট লিখতে বসবে ঘুরে ফিরে সেই সাবমিশনের ঘণ্টাকয়েক আগেই। আমাদের সবচেয়ে বড় সমস্যা হলো আমাদের হুঁশ ফেরে একদম শেষ মুহূর্তে।
সময়সীমা শেষ হওয়ার ঠিক আগমুহূর্তে ফেরা এই হুঁশটাকে সবসময় যাতে কাজে লাগানো যায় সে জন্য সাধারণ পড়াশোনা কিংবা কাজ করার ক্ষেত্রেও এই সময়সীমা আর লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণের অভ্যাস করতে হবে। কারণ এতে করে আমাদের মধ্যে কাজ বা পড়া শেষ করার তাড়না কাজ করবে। এই ছোট্ট, ছোট্ট সময়সীমা আর লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ আর সেগুলো অনুসরণ করার মাধ্যমে আমাদের সময়ের কাজ সময়ে করার অভ্যাসটাও গড়ে উঠবে। 
১১) হারানো মনোযোগ ফেরাতে “Pomodoro Technique” কাজে লাগাও –
মনোযোগ ধরে রাখা পৃথিবীর সবচেয়ে কঠিন কাজগুলোর মধ্যে একটি। যেকোনো একটা ক্লাস কিংবা লেকচারের শুরুতে মনোযোগ বা আকর্ষণ থাকে একেবারে শীর্ষে অর্থাৎ চূড়ায়। সময়ের সাথে সাথে এটা প্রতিনিয়ত কমতে থাকে। এই লেখার কথা যদি বিবেচনা করা হয়, পাঠকের আকর্ষণ শুরুতে যতখানি ছিলো লেখার এ অংশে এসে এর চেয়ে অনেকখানি কমে গেছে এটা নিশ্চিতভাবে বলে দেওয়া যায়।
বৈজ্ঞানিক গবেষণায় প্রাপ্ত তথ্য অনুযায়ী এটা প্রমাণিত যে, মানব মস্তিষ্ক একটানা ২০-৩০ মিনিটের বেশি কখনো মনোযোগ ধরে রাখতে পারে না। এই সময়ের পর মনোযোগ ক্রমশ কমতে থাকে। কিন্তু এই ক্রমশ কমে যাওয়া মনোযোগকে ফিরিয়ে আনারও উপায় আছে বৈকি। এই উপায় এর নামই হলো “Pomodoro Technique.” পড়া কিংবা যেকোনো কাজ করার সময় ২৫ মিনিট পরপর ৫-১০ মিনিটের ছোট্ট একটা বিরতি নেওয়া এবং এরপর আবার শুরু করার প্রক্রিয়াই হলো “Pomodoro Technique.” এতে করে আগ্রহ, মনোযোগ দু’টোই ফিরবে।
১২) একটু শারীরিক কসরত করলে কিন্তু বেশ সতেজ লাগবে – 
পড়তে বসার আগে একটু হালকা ব্যায়াম বা শরীরচর্চা করে নিলে অনেকটা সতেজ লাগবে পড়ার সময়। গোসলও করা যেতে পারে। ব্যায়ামে আগ্রহ না থাকলে পুরো বাসায় একটা চক্করও দেওয়া যেতে পারে। প্রফুল্ল আর সতেজ মন নিয়ে পড়তে বসলে সেই পড়াটা মনেও থাকবে বেশি।
১৩) মোবাইলে নোট নেওয়া আর কম্পিউটারে পিডিএফ পড়া কমিয়ে দাও –
ডিজিটাল এই যুগে মোবাইলে নোট নেওয়া কিংবা ল্যাপটপ বা ডেস্কটপ থেকে পিডিএফে বইয়ের সফট কপি পড়াটাই এই প্রজন্মের অভ্যাস হয়ে গেছে। অথচ, মোবাইলে নোট নেওয়ার চাইতে খাতায় কলমে হাতে লিখে নেওয়া নোটের স্থায়িত্ব স্মৃতিতে অনেকখানি বেশি। কারণ, খাতায় কলমে নোট নিলে প্রয়োজনসাপেক্ষে আঁকাআঁকি কিংবা ডুডলিং করেও রাখা যায় যেটা ফোনে নোট নিতে গেলে করা যায় না।
আর আঁকা জিনিস স্মৃতিতে অধিকতর স্থায়ী। আর, সফটকপির চাইতে হার্ডকপি অর্থাৎ বই থেকে পড়াটা বেশি কার্যকর। ফোন কিংবা ল্যাপটপ বা ডেস্কটপে পিডিএফ থেকে পড়ার সময় নোটিফিকেশনের যে বিড়ম্বনা সেটা হার্ডকপি অর্থাৎ বই থেকে পড়ার সময় থাকে না। সত্যি সত্যির পড়ায় মনোযোগ ধরে রাখা সম্ভব হয়। 
এখন থেকে মোবাইলে নোট নেওয়ার বদলে ডায়েরি কিংবা খাতায় নোট নাও। আর পিডিএফ বা সফট কপি না পড়ে হার্ডকপি থেকে পড়ার অভ্যাস করো।
১৪) ব্যবহারিক জ্ঞানে জোর দাও – 
জ্ঞানের ব্যবহারিক প্রয়োগে দক্ষতা বাড়ে। তাই বিজ্ঞানের জ্ঞান যেগুলোর বাস্তবিক আর ব্যবহারিক প্রয়োগ সম্ভব সেগুলো হাতে-কলমে প্রয়োগ করে এবং পরীক্ষা-নিরীক্ষার মাধ্যমেই শেখা উচিত। তাহলেই সে শেখা পাকাপোক্ত হবে।  
এরপর থেকে মনোযোগ নিয়ে অভিযোগ আর নয়। এই কৌশলগুলো কাজে লাগিয়ে বাড়িয়ে ফেলো মনোযোগ আর পড়াশোনাকে করে ফেলো আরও বেশি দ্রুত ও কার্যকরী। শুভকামনা রইলো তোমাদের সবার জন্যে!  

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

0 মন্তব্যসমূহ