‘একজন মানুষকে এক মাস সময় দিন, সে এক মাস লাগিয়েই করবে। মাথায় পিস্তল ঠেকিয়ে দু’মিনিটে করতে বলুন, সে দু’মিনিটেই করবে’।- পারকিনসন’স ল’।
সাধারণত আমরা দ্বিধা ও সিদ্ধান্তহীনতা- এ দুটো ব্যাপারকে খুব অপছন্দ করি, কিন্তু জীবনে অসংখ্যবার এদের মুখোমুখি হতে হয়। স্টপওয়াচ টিকটিক করে শেষ মুহূর্তের দিকে এগিয়ে যেতে থাকে, আমরা ভয়ার্ত চেহারায় ঘড়ির দিকে তাকিয়ে থাকি কিন্তু ঠিক অপশন কোনটা তা আমরা বুঝে উঠতে পারি না।
শেষ মুহূর্ত পর্যন্ত আমরা কোনোটাই ছাড়তে চাই না, সব ধরে রাখতে চাই হাতের মুঠোয়, ভাবি বিপদ কাটিয়ে উঠতে পারবো, শেষ মুহূর্তে ‘মিরাকিউলাস’ কিছু একটা করে ফেলতে পারবো। কিন্তু শেষ অবধি, বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই সব ছাড়তে হয় এবং ছেড়ে লাভ হয় না। সিদ্ধান্তহীনতা দোষের কিছু না, কিন্তু মাঝে মাঝে এ নিয়ে বেশ ঝামেলায় পড়তে হয় আমাদের! চলুন পড়ে নেয়া যাক, সিদ্ধান্তহীনতা থেকে উত্তরণের আসলেই কি কোন উপায় আছে?
ভাবিয়া করিও কাজ, করিয়া ভাবিও না
কখনো কখনো দ্বিধা আসবার আগেই কাজ করে ফেলতে হয়। ভাবাভাবি, প্ল্যান, দ্বিধা, সংশয়- সব কাজের আগে, কখনোই মাঝখানে বা পরে নয়। রেফারি অফসাইডের হুইসেল দেয়ার আগেই যদি বল পোস্টে ঢুকিয়ে দিতে পারেন তাহলে গোলটা ভ্যালিড হয়ে যেতেও পারে। যে মুহূর্তে আপনি থামবেন, ভাবতে বসবেন, স্পিড কমাবেন, তখুনি বুঝবেন আপনি হারতে বসেছেন। সিদ্ধান্তহীনতায় ভোগা মানুষদের সব সময় যে কোনো কাজ করার সময় মাথায় রাখতে হবে,“Think before you do.”।মাইন্ড ইন্সট্রাকশন
বিভিন্ন বইতে ইন্সট্রাকশন হিসেবে এমনটা বলা হয়- একটা টাইম প্রেশারের পরীক্ষায় কখন বুঝবেন যে আপনি বিপদে পড়েছেন? যখন দেখবেন যে মিনিট দুয়েক ধরে আপনার কলম চলছে না, আপনি কিছু ভাবতে পারছেন না, অথবা একটা সমস্যা সমাধান করতে অনেক কাটাকুটি খেলতে হচ্ছে, সময় বেরিয়ে যাচ্ছে কিন্তু শেষ করতে পারছেন না সমস্যাটি। তখন জাস্ট স্কিপ করে পরের প্রশ্নে চলে যান- একটা কিছু নিয়ে বসে থেকে সবই খোয়ানোর চাইতে অন্য কিছু খানিকটা করে কিছু লুটে নিতে পারা লাভজনক। আমরা মনে করি যে দু’মিনিট বেশী সময় দিলে হয়তো সঠিক সমাধান করে পুরো নম্বর তুলে নিতে পারবো, কিন্তু তার চেয়ে এটার অর্ধেক আর ওটার অর্ধেক করে যদি বেশী পান- তাহলে কিন্তু সেটাই লাভ বেশী।আমি খুব অ্যাকুরেট ধাঁচের মানুষ, সঠিক ছাড়া উত্তর করি না, ভুল-ভাল লিখি না- এমন গোঁড়ামি ছাড়তে হবে (যেহেতু আটকে গেছেন, কাজেই প্রমাণিত হয়ে গেছে যে আপনার অ্যাকুরেসির লোভ আপনার বিপদ বাড়ানো ছাড়া আর কিছু করবে না!)।
আবেগ সংবরণ
পজিটিভ কিছু দেখতে চাইলে কোনটা আরামদায়ক বা আনন্দময় তা ভাববেন না- ভাববেন কোনটা লাভজনক। নিজেকে প্রশ্ন করুন- কোনটা আপনি চান, লাভজনক পথ নাকি আনন্দময় পথ? খুব কঠিন প্রশ্ন?মনে রাখতে হবে, সঠিক সিদ্ধান্ত নেয়াটা জরুরী, তাতে আপনার বা অন্য কারো কতটুকু কষ্ট হল তাতে কিছু যায় আসে না- আবেগ বা কষ্টের এক পয়সা দামও কেউ প্র্যাক্টিক্যাল লাইফে দেয় না এবং পায় না। একটা ভুল সিদ্ধান্ত নিয়ে সারাজীবন কান্নাকাটি করার চেয়ে একটা সঠিক সিদ্ধান্ত নিয়ে সারাজীবন কান্নাকাটি করা অনেক ভালো! প্রথম ক্ষেত্রে আমও যাবে, ছালাও যাবে- অর্থাৎ কষ্টও পাবেন এবং যা চেয়েছেন তা পাবেন না; দ্বিতীয় ক্ষেত্রে অন্তত ছালাটা থাকবে(!), অর্থাৎ কষ্ট হলেও যা দরকার সেটা পেয়ে যাবেন।
বিষন্নতা কেন দ্বিধান্বিত করে?
জানেন কি, সিদ্ধান্তহীনতার অন্যতম মূল কারণ ডিপ্রেশন বা বিষন্নতা? ডিপ্রেশন ও সিদ্ধান্তহীনতার কারণগুলো অনেক সময় নির্ণয় করা যায় না। আমরা নিজেরাই এ প্রভাব বা প্রতিক্রিয়াগুলো সম্পর্কে অনেক সময় সজাগ থাকি না বা থাকতে পারি না। দিনে আমরা কয়েকশ সিদ্ধান্ত নেই ও বহুবার সিদ্ধান্তহীনতায় ভুগি। যেমন- কখন ঘুমাতে যাবো? কোন পথ দিয়ে গেলে দ্রুত পৌঁছানো যাবে? কোন কথা কীভাবে, কখন বলবো? বলা ঠিক হবে কিনা? কোনো কাজে যাওয়ার ক্ষেত্রে কখন যাবো? আজ যাবো কিনা?এ তো গেলো সাধারণ ছোট ছোট ব্যাপার। আরও অনেক গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্ত রোজ আমাদের নিতে হয়। বেশিরভাগ মানুষ এসব সিদ্ধান্ত সেকেন্ডের মধ্যে নিয়ে ফেলে। কিন্তু depressed ব্যক্তিরা ছোটখাটো ব্যাপারগুলো নিয়ে সিদ্ধান্তে পৌঁছাতে দ্বিধায় ভোগে। তাদের ধারণা, তারা সুফলদায়ক বা উপযুক্ত সিদ্ধান্ত নিতে পারবে না। ভবিষ্যত ফলাফল নিয়ে এরা খুব বেশি অনিশ্চয়তায় ভোগে। ফলে ভুল সিদ্ধান্ত হতে পারে বলে অনেকখানি সময় নেয় তারা।
করণীয়ঃ
১। জটিল সিদ্ধান্ত প্রয়োজন বুঝে এড়িয়ে যান অথবা কারও পরামর্শ নিন। অনেক ক্ষেত্রে পরামর্শ গ্রহণ করা বা না করা নিয়ে ঝামেলায় পড়তে পারেন। সেক্ষেত্রে নির্ভরযোগ্য কাঁধে ভরসা রাখুন।
২। পজিটিভ চিন্তা করুন। নিজেকে পজিটিভ কথা বলুন।
৩। কোন কিছু নিয়ে খুব বেশি ভাববেন না। কারণ ভবিষ্যৎ আমাদের কারও জানা নেই। আমরা কেবল সৎভাবে এগিয়ে যেতে পারি। বাকিটা ছেড়ে দিন।
ইতিবাচক চিন্তা
দ্বিধা-দ্বন্দ্ব করারও সঠিক সময় আছে! আক্ষেপ যখন করবেনই, তখন ঠিক সময়ে করুন। আমরা সাধারণত সবচেয়ে বেশী আক্ষেপ করি পরীক্ষার হল থেকে বেরিয়ে, যখন আক্ষেপ করাটা সবচেয়ে বেশী অর্থহীন। চাপটা কয়েক দিন আগে নিলে হয়তো খারাপ সময়টা আদৌ দেখতেই হত না। আপনি নিজের সমস্ত চিন্তা এবং দ্বিধার একটা তালিকা করুন এবং অপ্রয়োজনীয় বা ক্ষতিকর দ্বিধা, যেগুলো দিয়ে আসলে কোন ফায়দা পাচ্ছেন না- সেগুলোকে ঘ্যাঁচ করে কেটে দিন। শুধু শুধু এক সমুদ্র চিন্তার পাহাড় মাথায় নিয়ে সিদ্ধান্তহীনতায় ভোগা আর স্ট্রেস নেয়ার কোন মানে হয়না।মাথায় রাখুন প্রফিটের চিন্তা
লোভকে উপেক্ষা করে চলুন। লোভকে উপেক্ষা করতে পারে এমন মানুষের সংখ্যা কম। আপনি যখন শেয়ার বাজারে বিনিয়োগ করতে যাবেন, আপনি হয়তো টেরও পাবেন না যে নিজের টাকাকে কয়েকগুণ করতে গিয়ে আপনি ঘটি-বাটি, কাঁথা-কম্বল সবই বন্ধক রেখে বসেছেন।কখনোই এমন কিছুতে ঢুকবেন না, যেখানে যা নিয়ে ঢুকেছেন নিশ্চিতভাবে তার চেয়ে বেশী নিয়ে বেরুতে পারবেন না।
Calculated Risk
কেউ কেউ স্বভাবগতভাবেই হয় একটু অ্যাডভেঞ্চারাস প্রকৃতির, অর্থাৎ রিস্ক নিতে পছন্দ করে, নিজের যা আছে সমস্তই বিপদাপন্ন করতে দ্বিধা করে না। কেউ কেউ আবার খুবই রিজার্ভড প্রকৃতির- কোনক্রমেই নতুন কিছুর দিকে হাত বাড়াবে না, পাছে বিপদে পড়ে। কেউ কেউ মাঝামাঝি পর্যায়ের।যৌক্তিকতা আমাদেরকে বলে যে, কোন একটা ডিসিশন নেয়ার সময় এলে নিজের প্রকৃতির ওপর নয়, বরং পরিস্থিতির ওপর ভিত্তি করে সিদ্ধান্ত নেয়াটা নিরাপদ উপায়। আমি রিস্ক নিতে পছন্দ করি বলেই যে ভাগ্য আমার সমস্ত রিস্কের পজিটিভ আউটপুট এনে দেবে তার কোন নিশ্চয়তা নেই, কাজেই Calculated Risk নেয়াই ভালো। হারলে কিন্তু পরাজয়টাই আসে না, আসে হতাশা, পরের কাজের জন্য উৎসাহের অভাব, মানুষের বাক্যবাণ। মারফির ল’ অনুযায়ী,
সবকিছুই যদি ভেস্তে যায় তাহলেও যেন আপনার হাতে কিছু থাকে, আপনি যেন পথে না বসেন।
কাজেই সাবধান! নিজের সবকিছুকে নিয়ে বাজি ধরবেন না। পরের প্ল্যান করার জন্য মাল-মশলার অভাব যেন না হয়!আস্থা বজায় রাখুন
যে কোন ঠুনকো ব্যাপারে যদি নিজের প্রতি নিজের আস্থা হারায়, তাহলে তো সাফল্য আসার আগেই সেটা ‘আকাশের চাঁদ’ হয়ে যাবে! যে কোন সাধারণ বিষয়ে অন্য মানুষের কথায় নিজের প্রতি আস্থা হারাবেন না। যদি তা-ই হয় তবে জীবনে অনেক অনেকবার আপনাকে শুধু হতাশার ঝুড়ি নয় কষ্টের আর লজ্জার ঝুড়িও মাথায় নিতে হবে। যা কিছুই করবেন, নিজের উপর পূর্ণ আস্থা নিয়ে করবেন।একটা কথা মনে রাখবেন, প্রতিটা মানুষেরই একটি স্বকীয় স্বত্তা থাকে। আপনি একটা বিষয় যেভাবে কিংবা যে দৃষ্টিকোণ থেকে ভাবছেন, অন্য কেউ হয়তো সেভাবে ভাবছে না। কিন্তু এর মানে এই না যে, আপনার সিদ্ধান্ত কিংবা আপনি ভুল। নিজেকে আর নিজের সিদ্ধান্তগুলোকে শ্রদ্ধা করুন। ইচ্ছাগুলোকে ভালোবাসুন। দেখবেন, দিনশেষে আপনি Loser না Gainer– ই হবেন।
প্ল্যান হোক গোছানো। আমরা যেন আমাদের দ্বিধাগুলো থেকেও শক্তিশালী হতে পারি। সিদ্ধান্ত নিতে গিয়ে একবেলা চলে গেলে ঐ একবেলাই ‘লস’। তার চেয়ে শুরু করে দিন! নিজেকে চিন্তাপ্রবণ ভেবে তো অনেক সময় চলে গেছে, এবার মাঠে নেমে পড়ুন। কাজ করুন। সিদ্ধান্তগুলো হোক স্বাচ্ছন্দ্যপূর্ণ; সিদ্ধান্তহীনতায় ভুগে দ্বিধান্বিত হয়ে নয়!
0 মন্তব্যসমূহ