“যে রাঁধে, সে চুলও বাঁধে।” বহুল প্রচলিত এই কথাটি সবার জানা। তবে নারীর বিচরণ এখানেই সীমাবদ্ধ নয়, তাদের বিচরণ পৃথিবীর সর্বত্র, বহু বিস্ময় জাগানিয়া কৃতিত্বের সাথে স্বর্ণাক্ষরে জড়িয়ে আছে অসংখ্য গুণী নারীর নাম। আজ এমনই তিনজন অসমসাহসী, বীরাঙ্গনা নারীর গল্প নিয়ে আমাদের এই আয়োজন।
১। জোন ব্যারে (Jeanne Baret)
সমুদ্রপথে পৃথিবী পাড়ি দেওয়া প্রথম নারী!জোন ব্যারের জন্ম অষ্টাদশ শতাব্দীর মাঝামাঝিতে, ফ্রান্সের “ল্যা কোমেল” নামে এক গ্রামে। সেকালে নারীদের জন্য ঘরের বাইরে বের হওয়াই ছিল দুষ্কর, আর সমুদ্র পাড়ি দেওয়া তো আকাশ কুসুম কল্পনা। কিন্তু ব্যারের চঞ্চল মন তো এত কিছু মানে না! সাগরের নীল দিগন্ত বিস্তৃত ঢেউ তাকে বড্ড টানে, ডাঙ্গায় এই সাদামাটা জীবনে তার মন হাঁপিয়ে উঠলো। তাই একদিন দারুণ এক বুদ্ধি আঁটলেন ব্যারে। মুখে নকল গোঁফ লাগিয়ে, মাথায় টুপি পরে পুরুষ সেজে চাকরি নিলেন এক উদ্ভিদ বিজ্ঞানীর সহকারী হিসেবে!
বিজ্ঞানী মশাই সমুদ্র সফরে যাচ্ছেন অজানা দ্বীপের সন্ধানে, এমন চটপটে একটি সহকারী পেয়ে দারুণ খুশি হলেন তিনি। গবেষণার যন্ত্রপাতি, এলাহি লস্কর বাহিনী নিয়ে জাহাজে চেপে বসলেন তিনি সদলবলে, ঘুণাক্ষরেও টের পেলেন না জলজ্যান্ত একটি রমণীও রয়েছে তাদের সাথে, একই জাহাজে! দিব্যি সবার চোখের ডগায় সানন্দে ঘুরে বেড়াচ্ছেন ছদ্মবেশী ব্যারে, প্রতিদিন নতুন কিছু আবিষ্কারের উত্তেজনায় আর জীবনে প্রথমবারের মতো সমুদ্র পাড়ি দেওয়ার আনন্দে বিভোর তিনি, জান-প্রাণ দিয়ে খাটছেন গবেষণার কাজে বিজ্ঞানীর সাথে।
পৃথিবীর এপার ওপার চষা হয়ে গেল তাদের, অজস্র নাম না জানা উদ্ভিদের নমুনা দিয়ে বোঝাই তাদের জাহাজ, এবার ঘরে ফিরবার পালা। কিন্তু মাঝ দরিয়ায় আচমকা আকাশ-পাতাল একাকার করে দেওয়া তুফান উঠলো, ঝড়ো ঢেউয়ের তীব্রতায় কে যে কোথায় ছিটকে গেল তার আর হদিস পাওয়া গেল না। জোন ব্যারে অতিকষ্টে প্রাণ বাঁচিয়ে ফিরলেন প্যারিসে, সাথে সেই অজানা বিচিত্র সব উদ্ভিদের নমুনা।
প্রকৃতি বিজ্ঞানের সবচেয়ে বড় জাদুঘরের কাছে গেলেন তিনি সেই নমুনা নিয়ে, গুণে দেখা গেল প্রায় তিন হাজার অচেনা সব নমুনা নিয়ে এসেছেন ব্যারে, যেগুলো সভ্যদুনিয়ার কেউ কোনদিন দেখেনি আগে, বিজ্ঞানীরা সবাই তো অবাক! ধন্য ধন্য পড়ে গেল এই দুঃসাহসী বীর “পুরুষ” টির নামে! এমন সময় সকলের সামনে একটানে মুখের নকল গোঁফ তুলে ফেললেন ব্যারে, ছুঁড়ে ফেললেন মাথার টুপি, সবার চোখ কপালে তুলে দিয়ে নেমে এলো ব্যারের কোমর পর্যন্ত দীঘল বিস্তৃত কেশরাজি।
“নারীরাও সমুদ্র বিজয় করতে পারে” দৃপ্তকণ্ঠে সমবেত অতিথিবৃন্দের সামনে ঘোষণা করলেন তিনি, শ্রদ্ধায় করতালিতে মুখরিত হয়ে উঠলো গোটা হলঘর। রাজকীয় সম্মানে এবং পুরষ্কারে ভূষিত হলেন জোন ব্যারে, পৃথিবীর বুকে রেখে গেলেন অদ্বিতীয় এক সাহসিকতার দৃষ্টান্ত।
২। মেরি কুরি (Marie Curie)
প্রথম নোবেল বিজয়ী নারী, এবং পৃথিবীর বুকে একমাত্র নারী যিনি একাধিকবার নোবেল পুরষ্কার জিতেছেন, তাও আবার দুটি ভিন্ন বিষয়ে!১৮৬৭ সালে পোল্যান্ডে জন্ম নেওয়া মেরি কুরি ছোটবেলা থেকেই অসম্ভব প্রতিভার পরিচয় দিয়ে এসেছেন। স্কুলে বরাবর প্রথম হওয়া এই মেয়েটি প্রথম ধাক্কা খায় বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়তে গিয়ে, যখন জানতে পারে তাঁর এলাকার বিশ্ববিদ্যালয়টি কেবল “পুরুষ”দের জন্য উন্মুক্ত এবং সেখানে তাঁর কোন প্রবেশাধিকার নেই! এ কথা শুনে ভীষণ জেদ চেপে গেল কুরির, ছেলেবেলায় মা হারানো মেয়েটি সিদ্ধান্ত নিলো বিজ্ঞান চর্চার অভিযান চলবেই!
যেই ভাবা সেই কাজ, শহরের এক কোণে “ভাসমান বিদ্যালয়” নামে একটি জায়গা ছিল, যেখানে গোপনে কুরির মত অনেক জ্ঞানপিপাসু মেয়ে পড়ালেখার সুযোগ পেত। কিন্তু এ সুযোগও বেশিদিন টিকলো না। অর্থের অভাবে বন্ধ হয়ে গেল বিদ্যালয়টি, কুরিও পড়লেন জীবনযুদ্ধের নানা বিড়ম্বনায়। বহু বছর শিক্ষকতা আর গভর্নেনসের কাজ করে সংসারের খরচ যোগাতেন তিনি। অবসর সময়ে পদার্থ, রসায়ন ইত্যাদি বিষয় নিয়ে বুভুক্ষের মত পড়াশোনা করতেন। কিন্তু এভাবে আর কতদিন? অবশেষে বহু বছরের যা কিছু সম্বল সব নিয়ে পাড়ি জমালেন তিনি প্যারিসে, ভর্তি হলেন বিখ্যাত সরবোন বিশ্ববিদ্যালয়ে।
বিজ্ঞানের বিচিত্র সব বিষয় নিয়ে নাওয়া-খাওয়া ভুলে গবেষণা করতে লাগলেন কুরি, কিন্তু রোজগার? রোজগার করতে গেলে গবেষণার সময় কমে যাবে, তাই জ্ঞানপিপাসু কুরি কোনমতে আধবেলা একবেলা খেয়ে সারাদিন পড়ে থাকতেন গবেষণাগারে। স্বাস্থ্যের প্রতি নিদারুণ অযত্নের ছাপ পড়তে শুরু করলো শরীরে, চোখমুখ বসে গেল মানুষটার, তারুণ্যের উচ্ছ্বল সৌন্দর্য্যে ভর করলো ক্লান্তির ছাপ, কিন্তু কুরির চোখের দিকে তাকালে তা বুঝবার উপায় নেই!
তার চোখে রাজ্যের আগ্রহ আর কৌতূহল জ্বলজ্বল করছে, নিত্যনতুন সব অজানা বিষয়ে গবেষণায় তার দিনরাত কেটে যাচ্ছে মনের আনন্দে! এই গবেষণাগারেই পরিচয় হলো তার এক ফরাসী পদার্থ বিজ্ঞানীর সাথে, নাম তার পিয়েরে কুরি। বিজ্ঞান সাধনায় দুজনেরই অসীম আগ্রহ, পরিচয় তাই পরিণয়ে রূপ নিতে বেশিদিন লাগলো না। দুজন মিলে পদার্থ, রসায়ন, গণিত সহ বিজ্ঞানের নানান শাখায় গবেষণায় কাটাতে লাগলেন দিনরাত।
বিশ্ববিদ্যালয়টির ইতিহাসে প্রথম নারী প্রফেসর হলেন তিনি
বিজ্ঞানী যুগলের এই গবেষণা বিফলে গেল না, বিয়ের মাত্র আট বছরের মাথায় পদার্থবিজ্ঞানে নোবেল জিতলেন দুজন একসাথে! পুরষ্কারের অর্থ প্রায় পুরোটাই খরচ করলেন গবেষণার কাজে, সংসার আলো করে এলো কুরি দম্পতির প্রথম সন্তান, কিন্তু এমন সময় একটি বিপর্যয় এলোমেলো করে দিলো মেরি কুরির জগৎ। সড়ক দুর্ঘটনায় মারা গেলেন প্রিয়তম স্বামী, বিজ্ঞান চর্চায় সহকর্মী পিয়েরে কুরি।চোখের জলে ভাসলেন শোকে বিহ্বল কুরি, কিন্তু দাঁতে দাঁত চেপে সিদ্ধান্ত নিলেন স্বামীর গবেষণাকে এগিয়ে নিয়ে যাবেন। খরচ যোগাতে সরবোনে যোগ দিলেন শিক্ষক হিসেবে, বিশ্ববিদ্যালয়টির ইতিহাসে প্রথম নারী প্রফেসর হলেন তিনি। ১৯১১ সালে রসায়নে অনন্য অবদান রাখার জন্য আবার নোবেল পুরষ্কারে ভূষিত হলেন মেরি কুরি, সবার চোখের সামনে পুরষ্কার বিতরণী মঞ্চে কুরি একাই উঠলেন, কিন্তু তাঁর মনের জগতে যে বিদেহী স্বামীর অবস্থান সবসময় হৃদয়ের মাঝে।
সারাজীবনের এত ধকল আর স্বামীর মৃত্যুর শোক কোনদিনই কাটিয়ে উঠতে পারেননি কুরি, দুঃখ ভুলতে রাত-দিন গবেষণাগারেই পড়ে থাকতেন, এই অস্বাভাবিক খাটুনির ধকল পড়তে শুরু করলো তার শরীরে,
বিষাক্ত তেজস্ক্রিয়তায় আক্রান্ত হলো পুরো দেহ, অবশেষে বিশ্বজুড়ে লাখো ভক্তকে চোখের জলে ভাসিয়ে নশ্বর পৃথিবী থেকে বিদায় নিলেন মেরি কুরি, সমাহিত হলেন প্রিয়তম স্বামীর পাশেই। বিজ্ঞানের জগতে তার অসামান্য অবদান বিশ্ববাসী শ্রদ্ধাভরে স্মরণ করবে চিরদিন।
৩। হেলেন কেলার (Helen Keller)
আলোর পথযাত্রী!১৮৮০ সালে যুক্তরাষ্ট্রের আলাবামায় কেলার দম্পতির কোল আলো করে এলো একটি ফুটফুটে কন্যাসন্তান, নাম রাখা হলো হেলেন। ছোট্ট হেলেন স্বভাবসুলভ চপলতায় মাতিয়ে রাখে সবাইকে, ঘর আলো করে রাখে শিশুমনের খুনসুটিতে। এমন সময় হঠাৎ ভীষণ জ্বরে পড়লো শিশু হেলেন। অনেকদিন লাগিয়ে সেই জ্বর সারলো, হেলেনের পরিবার হাঁফ ছেড়ে বাঁচলো। কিন্তু, মা উদ্বিগ্নচিত্তে খেয়াল করলেন, কই, দরজার ঘণ্টার আওয়াজে হেলেনের কোন বিকার নেই কেন? আগে তো আওয়াজ শুনলেই সবার আগে দৌড়ে যেত হেলেন!
দুরুদুরু বুকে ডাক্তারের কাছে নিয়ে শুনলেন সবচেয়ে খারাপ খবরটা- এই সর্বনাশা জ্বর হেলেনের শ্রবণশক্তি কেড়ে নিয়েছে! শুধু তাই না, অসুখ হেলেনকে চিরদিনের মত অন্ধ করে দিয়েছে! আকাশ ভেঙে পড়লো বাবা-মার উপর। এই নিদারুণ অসহায়ত্ব হেলেনকে উন্মাদ করে তুললো। আঁচড়ে কামড়ে ক্ষতবিক্ষত করে দেয় সে কাছের মানুষদের। উপায়ন্তর না দেখে হেলেনকে নিয়ে তার বাবা-মা পাড়ি জমালেন বাল্টিমোরে। সেখানে পরিচয় হয় এক তরুণী ডাক্তার এন সুলিভানের সাথে।
শুরু হলো শিশু হেলেনের জীবনের এক নতুন অধ্যায়। এদিকে হেলেনকে শেখাতে এসে সুলিভান পড়লেন মহা সমস্যায়। এমন দুরন্ত শিশু তিনি আর দেখেননি! শান্ত করে তাকে বসানোই দায়! বহুকষ্টে হেলেনকে তিনি নিয়ে গেলেন এক পুকুর পাড়ে। হেলেনের ছোট্ট হাতে ছোঁয়ালেন পানি, আরেক হাতে হাত ধরে লিখলেন “w-a-t-e-r” এতদিনে যেন কিছুটা শান্ত হলো হেলেন, এক রাতেই তার শেখা হয়ে গেল ৩০টি শব্দ!
সেই যে শেখার যাত্রা শুরু, তা আর থামেনি হেলেনের জীবনের শেষ দিনটি পর্যন্ত। সুদীর্ঘ পঁচিশ বছর সাধনা করে তিনি শিখলেন মানুষের সাথে আলাপচারিতা করার উপায়। পড়ালেখা করতে দৃঢ় সংকল্পবদ্ধ হেলেন ভর্তি হলেন কেমব্রিজে, ইতোমধ্যে তার এই সংগ্রামের কথা ছড়িয়ে পড়েছে সারা দেশে। এই সময়ে মার্ক টোয়েনের মতো বিভিন্ন গুণী ব্যক্তির সাথে পরিচয় ও বন্ধুত্ব হয় তাঁর। তাদের সংস্পর্শে হেলেন স্বপ্ন দেখলেন পৃথিবীকে বদলে দেওয়ার, নিজের জীবনে অভিজ্ঞতা নিয়ে লিখলেন অনন্য এক জীবনকাহিনী “The Story of My Life”।
পরবর্তী জীবনে হেলেন প্রতিবন্ধীদের অধিকার আদায়ে অসামান্য অবদান রাখেন। বিভিন্ন দেশে বক্তব্য রাখেন এই মানুষটি শিক্ষা, অধিকার ও মানবতার উপর। অবদান রাখেন বিভিন্ন জনহিতৈষী কার্যক্রমে, সামাজিক ও রাজনৈতিক আন্দোলনে সোচ্চার ভূমিকা পালন করেন। জীবনসায়াহ্নে এসে হেলেন উপলব্ধি করলেন পৃথিবীকে আরো কিছু দেবার আছে তার, তাই বেরিয়ে পড়লেন জীবনের সবচেয়ে কঠিন অভিযানে- পাঁচ মাস ব্যাপী সফরে ভ্রমণ করলেন এশিয়াজুড়ে চল্লিশ হাজার মাইল, বক্তব্য রাখলেন দেশে দেশে, অনুপ্রাণিত করলেন শত কোটি মানুষকে।
এতদিনে যেন নিজেকে মুক্ত করলেন হেলেন। পৃথিবীর রূপ রস আপন আলোকে দেখা হয়নি জীবনে, মৃত্যুর পর স্রষ্টার দর্শনেই প্রথম চোখ মেলবেন তিনি, তাই ৮৮তম জন্মদিনের মাত্র অল্পকিছুদিন আগে ঘুমের মধ্যে পরম শান্তিতে শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করলেন হেলেন কেলার।
এই মহীয়সী নারীর চোখে জ্যোতি ছিল না, কিন্তু তার অন্তরের যে দ্যুতি তা তো ছড়িয়ে গেছে পৃথিবীজুড়ে, আলোকিত করেছে শত কোটি মানুষকে। জীবনজুড়ে মানুষটির পৃথিবী ছিল শব্দহীন, কিন্তু কাজের মাধ্যমে তিনি যে স্বপ্নময় এক পরিবর্তনের ঝংকার এনেছিলেন তা পৃথিবীবাসীর হৃদয়ে ধ্বনিত হবে চিরদিন।
0 মন্তব্যসমূহ