আমরা সাধারণত অল্পতেই হতাশ হয়ে যাই। তরুণ প্রজন্ম যেন এই ‘হতাশা’ নামক ব্যাধির মূল শিকার। তবে সবাই এই হতাশার শিকার হয়ে চুপচাপ বসে থাকে না। কেউ কেউ অদম্য সাহস নিয়ে দুর্বার গতিতে সামনে এগিয়ে চলে সব ধরণের বাধা-বিপত্তি ডিঙ্গিয়ে। একজনের জীবনে যত কালো অতীত কিংবা খুঁতই থাকুক না কেনো, বাধা ডিঙ্গিয়ে যারা চলতে থাকে তারা সফলতার দ্বারে পৌঁছুবেই।
আজকে আপনাদের এমন একজন মানুষের জীবনের গল্প শোনাবো, যিনি আমাদের মত স্বাভাবিক হাত-পা নিয়ে জন্মাননি। তিনি পৃথিবীতে এসেছেন হাত এবং পা ছাড়াই।
‘টেট্রা এনিমেলিয়া সিনড্রোম’ এর ফলে মানুষ কোনো হাত–পা ছাড়াই জন্ম নেয়। WNT3 জিনেরকারণে মানুষ এই রোগে আক্রান্ত হয়। ভ্রুণ অবস্থায় যখন মানুষের হাত, পা সৃষ্টি হতে থাকে তখনWNT3 জিনের কারণে হাত, পা সৃষ্টি বাধাগ্রস্ত হয়। এর ফলে অন্যান্য বিভিন্ন অঙ্গও স্বাভাবিক গঠনেবাধাগ্রস্ত হয়। তবে নিক ভুজিসিক এর ক্ষেত্রে শুধু হাত–পা সৃষ্টিই বাধাগ্রস্ত হয়েছে। অন্য সব কিছুরয়েছে স্বাভাবিক।
জন্মস্থান
১৯৮২ সালের ৪ ডিসেম্বর অস্ট্রেলিয়ার মেলবোর্ন শহরে নিক জন্ম নেয়। নিক ভুজিসিক এর পুরো নাম নিকোলাস জেমস ভুজিসিক। বেরিস ভুজিসিক ও ডুসকা ভুজিসিক এর ঘরে যখন নিকের জন্ম হয়, সন্তানের এরূপ আকৃতি দেখে নিক এর মা তাকে কোলে নিতে অস্বীকার করেন। পরবর্তীতে অবশ্য স্বামী-স্ত্রী দুজনেই তাকে ‘ঈশ্বরের ইচ্ছা’ হিসেবে বিবেচনা করে মেনে নেন।
জীবনের ‘টার্নিং পয়েন্ট’
নিক জীবনকে সব সময় ইতিবাচক দৃষ্টিতে দেখেন। তবে শুরুতে এমন ছিল না। স্কুল জীবনে মাত্র ১০ বছর বয়সে নিক আত্মহত্যার চেষ্টা করেন। সে যাত্রায় বাঁচার পরে তিনি সিদ্ধান্ত নেন, “পালিয়ে যাওয়া নয়, ইতিবাচক দৃষ্টিতে জীবনকে দেখে লড়াই করতে হবে”। এর পরের গল্পটা একেবারেই ভিন্নরকম।
মাত্র ১৭ বছর বয়সে তাঁর হাইস্কুলের এক দারোয়ান তাকে জনসম্মুখে বক্তৃতা দেয়ার জন্য উৎসাহিত করেন। ৫৩ বার প্রত্যাখিত হওয়ার পর, নিক যখন প্রথমবার মঞ্চে উঠলেন বক্তব্য দেয়ার জন্য তখন দর্শক সারি প্রায় পুরোটাই খালি হয়ে গিয়েছিলো।
নিক কিন্তু তাতেও হতাশ হননি। অভাবনীয়ভাবে খুব শিগগিরই তিনি অভূতপূর্ব সাড়া পান। নিকের সম্পর্কে তাঁর বন্ধুরা বলেন, তিনি এমন একজন মানুষ যিনি আনন্দের জন্য রোমাঞ্চ অভিযান খুঁজে বেড়ান।
ধীরে ধীরে মানুষের কাছে তিনি এতটাই জনপ্রিয় হয়ে উঠেন যে, ঘণ্টায় এক হাজার আটশত লোককে বুকে জড়িয়ে ধরার জন্য ‘গিনেজ বুক’ এ তাঁর নাম উঠেছে। মাত্র দুইটি আঙ্গুল থাকা সত্ত্বেও তিনি এতটা দ্রুত টাইপ করতে পারেন যা অনেক স্বাভাবিক মানুষও পারে না। মিনিটে তিনি ৪৭টি শব্দ টাইপ করতে পারেন। তিনি নিজেই বলেছেন,
“আমি উঠে দাঁড়াবার জন্য শতবার চেষ্টা করবো, যদি শতবারই ব্যর্থ হই তবুও ব্যর্থতা মেনে নিয়ে সেটা ছেড়ে উঠবো না। আমি আবার চেষ্টা করবো এবং বলবো, এটাই শেষ নয়”।
পড়াশোনা
নিক জন্মের পর থেকেই ‘স্বাভাবিক’ স্কুল ও কলেজে পড়াশোনা করেছেন। তাঁর কোনো পূর্ণাঙ্গ হাত-পা না থাকলেও বাম কোমরে দুই আঙুল বিশিষ্ট অপরিণত একটি পা রয়েছে। এই পা দিয়েই তিনি ভারসাম্য রক্ষা করে চলাফেরা করেন।
আমরা সাধারণত যেখানে একবার স্নাতক সম্পন্ন করতেই হিমশিম খেয়ে যাই সেখানে নিক ভুজিসিক দুই আঙুল দিয়েই ২১ বছর বয়সে ফিন্যান্সিয়াল প্ল্যানিং ও অ্যাকাউন্টিং এর মত বিষয় নিয়ে দুইবার স্নাতক সম্পন্ন করেছেন ‘গ্রিফিথ বিশ্ববিদ্যালয়’ থেকে।
কর্মজীবন
নিক ভুজিসিক ব্যাচেলর ডিগ্রি অর্জনের পর অনুপ্রেরণামূলক বক্তব্য দিতে পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে ভ্রমণ শুরু করেন। তিনি পাঁচ উপমহাদেশের ষাটটি দেশে ঘুরে প্রায় ত্রিশ লাখ মানুষের কাছে নিজের বক্তব্য পৌঁছে দেন।
নিক নিজের কাজ টিভি শো এবং নিজের লেখার মাধ্যমে জনসাধারণের কাছে পৌঁছে দেন। ২০১০ সালে তাঁর রচিত প্রথম বই “Life Without
Limits: Inspiration for a Ridiculously Good Life”প্রকাশিত হয়। এটি প্রায় ৩০ টি ভাষায় অনূদিত হয়েছে। তাছাড়াও আন্তর্জাতিকভাবে বেস্ট সেলার খেতাব অর্জন করেছে। এটি ছাড়াও এখন পর্যন্ত তিনি আরও পাঁচটি বই লিখেছেন। যেগুলোও প্রায় সমান জনপ্রিয়তা অর্জন করেছে।
ব্রিসবেন, অস্ট্রেলিয়া, লস এঞ্জেলস, ক্যালিফোর্নিয়া সহ বিভিন্ন জায়গায় নিক ‘Life Without Limbs’ নামের একটি অলাভজনক প্রতিষ্ঠান প্রতিষ্ঠা করেন। তিনি এর প্রতিষ্ঠাকালীন সভাপতি।
এছাড়া Attitude is Altitude নামে তাঁর আরও একটি সংগঠন রয়েছে। এ থেকে প্রণোদনামূলক বক্তৃতা এবং দুর্বলদের ঠাট্টা-বিদ্রূপ না করার জন্য প্রচারণা চালান তিনি। এছাড়াও যুব সমাজকে লক্ষ্য করে “No Arms, No Legs,
No Worries!” নামের একটি ডিভিডি প্রকাশ করেন।
পদক
“দ্যা বাটারফ্লাই সার্কাস” চলচ্চিত্রটিতে “উইল” চরিত্রে অনবদ্য অভিনয় করার জন্য ২০১০ সালে নিক ভুজিসিক “Method Fest
Independent Film Festival” এ সেরা অভিনেতা পদক লাভ করেন। চলচ্চিত্রটি ২০০৯ সালে “Doorpost Film
Project’s” এ প্রথম পুরস্কার অর্জন করে।
২০০৫ সালে যুব ‘অস্ট্রেলিয়ান অব দ্যা ইয়ার’ পুরস্কারের জন্য তিনি মনোনয়ন লাভ করেন।
জীবনসঙ্গী
এমন একজন মানুষের জীবনে স্বেচ্ছায় কোনো মেয়ের আসতে চাওয়া সত্যিই মনোমুগ্ধকর ব্যাপার।
২০১২ সালে নিক ভুজিসিক বিবাহ ইন্ধনে আবদ্ধ হন কানাই মিয়াহারার সাথে। তাদের এই বিয়ে ছিলো লাভ ম্যারেজ। মিয়াহারাকে একবার জিজ্ঞেস করা হয়েছিলো আপনার সন্তান যদি নিক এর মত হয় তাহলে আপনি কী করবেন? প্রত্যুত্তরে তিনি বলেন, “আমি তাকে আরেকজন নিক ভুজিসিক হিসেবে তৈরি করবো।”
বর্তমানে তাদের দুটি ছেলেও রয়েছে। ২০১৩ সালে তাদের প্রথম পুত্র কিয়োশি ও ২০১৫ সালে তাদের দ্বিতীয় পুত্র দিজান এর জন্ম হয়। স্ত্রী সন্তান নিয়ে নিক বর্তমানে দক্ষিণ ক্যালিফোর্নিয়া তে বসবাস করেন।
নিক ভুজিসিকের জীবন থেকে নেয়া ৬টি শিক্ষণীয় দিক:
১।
ভয়
হচ্ছে
সবচেয়ে
বড়
অক্ষমতা
ভবিষ্যতের ভয়, অতীতের ভয়, ব্যর্থতার ভয়- এই ভয়গুলো আপনাকে প্রতিনিয়ত যে কোনো কাজে আটকে দিবে। নিক এই ভয়গুলো কাটিয়ে উঠেছেন। হাত-পা ছাড়া জন্মগ্রহণ করা সত্ত্বেও, নিক ভুজিসিক সবসময় সিদ্ধান্ত নেয়ার সময় নির্ভীক ছিলেন।
তিনি লেখক, সিইও, স্পিকার ও পরিকল্পনাকারী। তিনি সব শারীরিক সীমাবদ্ধতাকে তুচ্ছ জ্ঞান করতে পেরেছেন। কারণ, তিনি সব থেকে বড় প্রতিবন্ধকতা ‘ভয়’ কে জয় করতে পেরেছেন!
২। সৃষ্টিকর্তার
উপর
বিশ্বাস
রাখা
“If you believe in God, you will have the hope.”
নিক ভুজিসিকের মতে, আমাদের প্রত্যেককেই পৃথিবীতে পাঠানোর পেছনে উদ্দেশ্য রয়েছে। তাই খারাপ সময়ে কোনোভাবেই আশা হারানো যাবে না।
৩। সাফল্য অর্জনের পথে কোনো রকম অব্যাহতিই গ্রহণযোগ্য নয়
নিকের কাছে তাঁর সব থেকে বড় অস্ত্র কোমরের নিচে থাকা দুই আঙুলবিশিষ্ট অপরিণত বাম পা টি। গুরুতর অক্ষমতা থাকা সত্ত্বেও তিনি প্রতিদিন অবিশ্বাস্য কাজ সম্পন্ন করার চেষ্টা করেন। সাঁতার, মাছ ধরা, সার্ফিং, স্কাইডাইভিং, স্নোবোর্ডিং এবং এমনকি গল্ফও খেলতে পারেন। তিনি প্রায় ৫ লাখ মার্কিন ডলার মূল্যের একটি প্রতিষ্ঠানের একজন সফল উদ্যোক্তা।
৪। ‘সবকিছু’ ঘটার পেছনে একটি কারণ থাকে
নিক বলেন,
‘ঈশ্বর আমাকে যেভাবে জন্ম দিয়েছেন এবং আমার সঙ্গে যা যা হয়েছে, তার পেছনে নিশ্চয়ই কোনো পরিকল্পনা রয়েছে। তুমি তোমার সাধ্য মতো চেষ্টা করে যাও, ঈশ্বর তোমাকে ফেরাবেন না’।
৫। পরিবার সব সময় গুরুত্বপূর্ণ
নিককে তাঁর পরিবার একজন স্বাভাবিক মানুষ হিসেবে ধরে নিয়েছিল। তাকে স্বাভাবিক স্কুলে পাঠিয়েছিল এবং খারাপ সময় মোকাবেলা করার সাহস দিয়েছিল। বিয়ের পর ব্যবসায় একবার খুব খারাপভাবে লোকসান হবার পরও তাঁর স্ত্রী সব সময় তাকে মানসিকভাবে সাপোর্ট করেছে যাতে নিক ভেঙ্গে না পড়ে।
৬। নিজেকে সব সময় ছাড়িয়ে যেতে হবে
যদি আপনি বিশ্বাস করেন যে জীবন ছোট এবং নিরর্থক, নিক আপনাকে ভুল প্রমাণ করবে এবং আপনার জীবনের লক্ষ্য অর্জনের জন্য আপনাকে বাধা দিতে পারে এমন প্রতিটি অজুহাতকে বিশ্রাম দিতে হবে।
নিক প্রতিদিন নিজের সীমাবদ্ধতাগুলোকে ছাড়িয়ে যাওয়ার চেষ্টা করেন এবং নিজের কাজ ও বক্তব্য দিয়ে বিশ্বের আরও কোটি কোটি লোককে অনুপ্রাণিত করার পথে আরও কয়েক ধাপ এগিয়ে যান।
নিজের সাথে নিজে যুদ্ধ করে আত্মবিশ্বাসী নিক ভুসিজিক পেরেছেন নিজেকে সফল মানুষদের কাতারে দাঁড় করাতে। ৩২ বছর বয়সী এই যোদ্ধা এখন বিশ্বের সেরা বক্তাদের একজন। জীবনের মানে তাঁর চেয়ে ভালো আর কে জানে!
0 মন্তব্যসমূহ