বর্তমানে বিশ্বের সবচেয়ে জনপ্রিয় সামাজিক যোগাযোগের মাধ্যম হচ্ছে ফেসবুক। শুধুমাত্র বাংলাদেশেই ৩০ মিলিয়নের বেশি ফেসবুক ইউজার রয়েছে। বিশ্বজুড়ে প্রায় ১৩০ কোটি মানুষ ফেসবুক ব্যবহার করছে এই মুহূর্তে। আকাশী নীলের এই বিপুল জনপ্রিয় মাধ্যমটির সূচনার গল্পটা কি জানা রয়েছে?
হার্ভার্ডের সেই বিশ বছরের তরুণ
ফেসবুকের প্রতিষ্ঠাতা মার্ক জাকারবার্গ (Mark
Elliot Zuckerberg) এ তো সবার জানা। ১৯৮৪ সালে জন্ম তাঁর নিউইয়র্কে। ছোটবেলা থেকেই প্রযুক্তির প্রতি ভীষণ ঝোঁক ছিল তার, স্কুলে পড়ার সময়েই তিনি তৈরি করেছিলেন জাকারবার্গ নেট নামের একটি সফটওয়্যার, যা তার বাবার কাজে সাহায্য করত।
প্রখর মেধাবী হওয়ায় উচ্চশিক্ষার্থে তিনি হার্ভার্ড কলেজে ভর্তি হওয়ার সুযোগ পান। কম্পিউটার ইঞ্জিনিয়ারিং এ দক্ষ জাকারবার্গ ২০০৩ সালে “ফেসম্যাশ ডট কম” নামে একটি সাইট তৈরি করেন। সাইটটিতে দুটো ছবি পাশাপাশি রেখে রসিকতাপূর্ণ কথাবার্তা করা হতো। যেহেতু তিনি একজন দক্ষ প্রোগ্রামার ছিলেন তাই হ্যাকিং করতে তেমন সমস্যা হতো না তার!
হার্ভার্ড কলেজের ডেটাবেজ হ্যাক করে শিক্ষার্থীদের ছবি নিয়ে তা ফেসম্যাশে ব্যবহার করেন দুষ্টুমি করে। কাজটি ভীষণ ছেলেমানুষি হলেও এখান থেকেই গল্পের শুরু। ফেসম্যাশ সাইটটিতে মাত্র ৪ ঘণ্টায় ৪৫০ ভিজিটর ২২০০০ ছবিতে অনলাইনে ভোট দেন। তার এই দুষ্টুমির ফলস্বরূপ কলেজের শিক্ষার্থীরা বিক্ষোভ করে সাইটটি বন্ধ করতে বাধ্য করে!
ফেসবুকের সূচনা
জাকারবার্গ এবার একটু সিরিয়াস হলেন। ক্যামেরন, টেইলর ও ডিভিয়া নামের তিন বন্ধুর সাথে মিলে “হার্ভার্ড কানেকশন” নামের একটি সাইটের জন্য কাজ করা শুরু করেন। কিছুদিনের ভেতর তিনি
thefacebook.com নামে একটি ডোমেইন কিনে নেন।
সাইটটি চালুর ২৪ ঘণ্টার মধ্যে ১২০০ জন শিক্ষার্থী সেখানে রেজিস্ট্রেশন করে! মজার ব্যাপার হচ্ছে জাকারবার্গের সেই তিন বন্ধু ক্যামেরন, টেইলর ও ডিভিয়া সাইটটি তৈরির ছয় দিনের মাথায় তাঁর বিরুদ্ধে আইডিয়া চুরির অভিযোগ আনে!
উত্থানের শুরু
জাকারবার্গ বন্ধুদের এই অভিযোগ তেমন আমলে নিলেন না। এইসব মামলা নিয়ে ভাববার সময় কোথায়, তিনি তখন বিশ্বজয়ের স্বপ্নে বিভোর!
বর্তমানে তার সম্পদের পরিমাণ ৭০ বিলিয়ন ডলার!
ফেসবুকের ব্যবহারকারীর সংখ্যা খুব দ্রুত গতিতে বাড়তে শুরু করেছে তখন, তৈরির মাত্র দু’মাসের মাথায় হার্ভার্ড ছাড়াও আরো বেশ কিছু কলেজে ফেসবুক পরিচিতি পায়। কয়েক মাসের মধ্যেই সাইটে প্রায় দেড় লাখ ইউজার প্রোফাইল খোলা হয়েছিল!
অনলাইনে আর্থিক লেনদেনের প্রভাবশালী কোম্পানি পেপাল- উদীয়মান ফেসবুকের সম্ভাবনা দেখতে পেয়ে তখনই এর ১০ শতাংশ শেয়ার কিনে নেয় পাঁচ লাখ ডলারে। কিন্তু পরে সাইট দুটো আলাদা হয়ে যায়- এ সিদ্ধান্তের জন্য পেপালকে আফসোস করতে হয়েছে, কারণ মাত্র পাঁচ লাখ ডলারে কেনা সেই শেয়ারের মূল্য এখন শত কোটি ডলার ছাড়ানো!
“thefacebook” থেকে “Facebook”
“thefacebook” থেকে “Facebook”
এতোদিন দা ফেসবুক নামে পরিচিত ছিলো সাইটটি। বছর ঘুরতে না ঘুরতেই দশ লাখের বেশি ইউজার জুটে যায় সাইটটিতে! নাম আরেকটু সহজ করতে ২০০৫ সালের আগস্ট মাসে
facebook.com ডোমেইনটি কিনে নেন জাকারবার্গ। এজন্য তাঁদের গুনতে হয়েছিল দুই লাখ মার্কিন ডলার!
লোভনীয় যত প্রস্তাব
ফেসবুকের শুরুর দিনগুলো থেকেই বহুবার ফেসবুককে বিক্রয় করার প্রস্তাব এসেছিল! বুদ্ধিমান দূরদর্শী জাকারবার্গ কারো কোনো প্রলোভনে পা দেননি। ফেসবুকের জন্মের মাত্র চার মাসের মধ্যেই বিক্রয়ের প্রস্তাব আসে নিউ ইয়র্কের একটি কোম্পানির কাছে থেকে।
বিশ বছর বয়সী জাকারবার্গের থেকে সেই সময়ই দশ লক্ষ ডলারে ফেসবুককে কিনতে চেয়েছিল কোম্পানিটি। ফেসবুক তখনও আয়ের মুখ দেখা শুরু করেনি, তথাপি জাকারবার্গ এই লোভনীয় প্রস্তাবে কোনো কর্ণপাত করেননি!
অনলাইন মুঘল হিসেবে পরিচিত গুগল প্রস্তাব দিয়েছিল ফেসবুককে একসাথে কাজ করার জন্য। কিন্তু জাকারবার্গ এখানেও নিজের সিদ্ধান্তে অটল রইলেন। এরপর ঘটলো এক মজার ব্যাপার- ১ মিলিয়ন ডলার থেকে একধাক্কায় ৭৫ মিলিয়ন ডলারের প্রস্তাব পায় ফেসবুক! কিন্তু ভায়াকম নামে প্রতিষ্ঠানটির এই দারুণ লোভনীয় প্রস্তাবও টলাতে পারেনি জাকারবার্গের মন।
ফেসবুকের ক্রমবর্ধমান জনপ্রিয়তা দেখে দূরদর্শী ব্যবসায়ীরা এখানে অর্থ বিনিয়োগ করতে শুরু করেন। ২০০৫ সালের মে মাসে “এক্সেল পার্টনার্স” প্রায় ১৩ মিলিয়ন ডলার ইনভেস্ট করে ফেসবুকে।
২০০৭ সালে আরো বিশাল অঙ্কের বিনিয়োগ ঘটে- হংকং এর একজন ব্যবসায়ী ৬০ মিলিয়ন ডলার বিনিয়োগ করেন, এবং মাইক্রোসফট ২৪০ মিলিয়ন ডলার বিনিয়োগ করে ফেসবুকের ১.৬% শেয়ার কিনে নেয়।
সাফল্যের শিখরে আরোহণ
বিনিয়োগকারীদের আর্থিক সহায়তায় এবং দক্ষ কর্মীদের সমন্বয়ে রাতারাতি অনলাইন জগতে এক পরাশক্তিতে পরিণত হয় ফেসবুক। ২০০৮ সালে তারা সবরকম আইনগত সমস্যাগুলোর সমাধান করে এবং প্রায় পাঁচ বিলিয়ন ডলারের কোম্পানীতে রূপ নেয়!
বছর ঘুরে ২০০৯ সাল এলো, সবাইকে অবাক করে দিয়ে তৎকালীন বহুল প্রচলিত স্যোশাল মিডিয়া সাইট “মাই স্পেইস ডট কম” কে পেছনে ফেলে দিলো ফেসবুক! এরপর আর ফেসবুককে পেছন ফিরে তাকাতে হয়নি।
মার্ক জাকারবার্গ নিজের মেধা এবং কর্মপরিকল্পনার গুণে মাত্র ২৩ বছর বয়সে বিলিয়নিয়ারে পরিণত হন। বর্তমানে তাঁর সম্পদের পরিমাণ ৭০ বিলিয়ন ডলার! ফেব্রুয়ারি ২০১৫ সালের হিসাব অনুযায়ী ফেসবুকের মূলধন ২১২ বিলিয়ন ডলারে গিয়ে উঠেছে।
ফেসবুক সম্পর্কে মজার কিছু তথ্য
·
অনেকেরই মনে প্রশ্ন জাগতে পারে ফেসবুকের রং কেন নীল? এর পেছনের কারণটা কিন্তু বেশ মজার! মার্ক জাকারবার্গের বর্ণান্ধত্ব রয়েছে, রং চিনতে দারুণ অসুবিধা হয় তার। সে জন্যই রঙের ক্ষেত্রে নীলকে ফেসবুকের জন্য বেছে নেয়া হয়েছে।
·
প্রতিদিন প্রায় ৬ লক্ষ মানুষ ফেসবুকে বিভিন্ন ইউজার একাউন্ট হ্যাক করার চেষ্টা করে!
·
১৮ থেকে ৩৪ বছর বয়সীদের প্রায় ৪৮ শতাংশই ঘুম থেকে উঠেই ফেসবুক চেক করে!
·
ফেসবুক থেকে লগ আউট করার পরও ফেসবুক কর্তৃপক্ষ চাইলেই তুমি কোন কোন সাইট ভিজিট করছো সেটি বের করে ফেলার ক্ষমতা রাখে!
·
ফেসবুকের প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা হিসেবে জাকারবার্গ ১ ডলার বেতন পান মাত্র! তার আয় আসে মূলত শেয়ার থেকে, তিনি একাই ফেসবুকের প্রায় ২৮% শেয়ারের মালিক।
·
ফেসবুকে এই মুহুর্তে প্রায় ৩০ মিলিয়ন মৃত মানুষের ইউজার একাউন্ট রয়েছে!
·
২০১১ সালে আমেরিকার এক তৃতীয়াংশ বিবাহ বিচ্ছেদের পেছনে প্রধান কারণ ফেসবুক!
·
সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমগুলোর ভেতর ফেসবুকেই সবচেয়ে বেশি ভাষা ব্যবহারের সুযোগ রয়েছে। সারা বিশ্বে ৭০টি ভিন্ন ভাষায় ফেসবুক ব্যবহার করা সম্ভব।
·
আজকাল যেকোন চাকরির ক্ষেত্রে চাকরিপ্রার্থীর ফেসবুক একাউন্টকে অত্যন্ত গুরুত্ব সহকারে যাচাই করে দেখা হয়। তাই অবশ্যই তোমার ফেসবুক একাউন্টটিকে সুন্দর করে সাজিয়ে তুলতে ভুলো না!
0 মন্তব্যসমূহ