কিছুদিন আগে গিয়েছিলাম সিলেটে। সেখানে মুহম্মদ জাফর ইকবাল স্যারের সাথে দেখা করার সৌভাগ্য হয়েছিল আমার। অসাধারণ এই মানুষটার সাথে শিক্ষা আর বাংলাদেশের শিক্ষাব্যবস্থা নিয়ে আমাদের বেশ খানিকক্ষণ আড্ডা জমেছিলো। সেখান থেকেই আমাদের এই স্বপ্নগুলোর দেখা পাই আমরা।
তাই ভাবলাম, স্বপ্নগুলো না হয় লিখেই ফেলি, জানিয়ে দেই পুরো বিশ্বকে!
যা শিখছি বুঝে শিখছি
আমরা অনেক সময় না বুঝে না জেনে অনেক কিছু পড়ে ফেলি, মুখস্ত করে ফেলি। আমরা কিন্তু জানিও না আসলে এই শিক্ষাটা আমাদের ঠিক কোন কাজে লাগবে, কেন কাজে লাগবে।আমি স্বপ্ন দেখি এমন একটি শিক্ষাব্যবস্থা, যেখানে স্কুল-কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়ের সব শিক্ষার্থীরা কোনকিছু পড়ার আগে জানবে, কেন তারা সেটি পড়ছে। তাদের পরিষ্কার ধারণা চলে আসবে যে এই বিষয়টি পড়লে তারা এইভাবে উপকার পাবে। তাদের মনে আর প্রশ্ন জাগবে না যে, এসব পড়ে কি হবে? কি লাভ?
গোল্ডেন নয়, শেখার জন্যে পড়ালেখা
একটা সময় ছিলো যে কেউ গোল্ডেন জিপিএ ফাইভ পেলে আমার খুব ভালো লাগতো। মনে হতো যে অসাধারণ একটা কাজ করে ফেলেছে সেই ছেলেটি বা মেয়েটি। কিন্তু এখন আর সেদিন নেই। এখন কেউ গোল্ডেন পেলে আমার মধ্যে এক ধরণের হতাশা কাজ করে। মনে হয়, এই রেজাল্টের জন্যে শিক্ষার্থীটিকে কতোই না ঝামেলার মধ্যে দিয়ে যেতে হয়েছে, বাবা মা নিশ্চয়ই তাকে গণ্ডায় গণ্ডায় কোচিং-প্রাইভেট আর মডেল টেস্টের জ্বালাতনে অতিষ্ঠ করে তুলেছে। রেজাল্ট একটুখানি খারাপ হলে না জানি তার বাবা মা তাকে কতো বকাঝকা করেছেন!তাই আমি স্বপ্ন দেখি সেই দিনের, যখন শুধু গোল্ডেন জিপিএ পাবার জন্যে কেউ পড়ালেখা করবে না, শেখার জন্যে পড়ালেখা করেই গোল্ডেন পেয়ে যাবে।
Never Stop Learning
এমন এক যুগে আমাদের বসবাস, যেখানে আমরা সিলেবাসের বাইরে এতটুকুও পড়তে চাই না। সিলেবাস তো সিলেবাসই, এর মধ্যেও আমরা শুধু পড়তে চাই পরীক্ষায় যেগুলো আসতে পারে। সাজেশন নির্ভর শিক্ষাব্যবস্থা হয়ে গেছে আমাদের। কিন্তু ব্যাপারটা হলো, শেখার কোন শেষ নেই।মানুষ হিসেবে আমরা সবাই এক-একটা বইয়ের মত। কেউ হয়তো ফিলোসফির বই, কেউ ফিজিক্সের। সবার কাছেই কিছু না কিছু শেখার আছে। সেজন্যে শেখার মানসিকতাটা ধরে রাখতে হবে। জীবনের শেষ মূহূর্ত পর্যন্ত যেন আমরা শিখে যেতে পারি, সে স্বপ্নই দেখি আমি।
মুখস্ত নয়, বুঝে পড়ো
নকল করা খুব খারাপ একটা কাজ। পরীক্ষার হলে মুখস্ত করে এসে উত্তরগুলো উগলে দেয়াটাও কিন্তু একরকম নকলই বলা চলে! একগাদা তথ্য মুখস্ত করে সেটা দিয়ে পরীক্ষায় পাশ করাটা মোটেও কাম্য নয়। মুখস্ত করার দরকার আছে, কিন্তু অবশ্যই সেটি বুঝে বুঝে করতে হবে। তাই আমি স্বপ্ন দেখি এমন এক বাংলাদেশের, যেখানে সবাই ঝাড়া মুখস্ত না করে বুঝে বুঝে পড়ালেখা করবে।
পড়ালেখায় ভালো হওয়াটা বুদ্ধিমত্তার স্রেফ একটা অংশ
পড়ালেখার পাশাপাশি সহশিক্ষাকে কৃতিত্বদান
আমাদের মনের মধ্যে একটা ধারণা ঢুকে গেছে যে, সিজিপিএ বা জিপিএ হচ্ছে জীবনের সব। এটি ছাড়া জীবনে ভালো কিছুই করা যায় না। কিন্তু ব্যাপারটা হলো যে, বিভিন্ন মানুষ কিন্তু বিভিন্ন ক্ষেত্রে ভালো। একটা বনে একটা বাঁশ পুতে দিয়ে যদি সিংহ, নেকড়ে, বাঘ, হাতি আর বানরকে বলা হয় যে, যেই প্রাণী আগে বাঁশে চড়তে পারবে, সে-ই সেরা। বানর হেসেখেলে চড়তে পারবে সেখানে। তার মানে কি সে সেরা? মোটেও না!
একইভাবে, সিজিপিএ ভালো না হলেই যে সে ভালো নয়, এমন ধারণা পাল্টাতে হবে। কেউ হয়ত ভালো ছবি আঁকে, ভালো গান গায়, ভালো কবিতা লেখে। এগুলো তো সিজিপিএতে কখনো আসবে না। তাই আমার স্বপ্ন হলো, এমন একটা দিন আসবে যখন একাডেমিক পড়ালেখার কৃতিত্বের পাশাপাশি এসব সহশিক্ষাকেও কৃতিত্বের সাথে দেখবে সবাই!
বুদ্ধির পরিচয় শুধু পড়ালেখায় নয়!
অনেকেরই ধারণা, বুদ্ধিমত্তা যাচাই করার একমাত্র উপায় হলো পড়ালেখা। পড়ালেখায় ভালো তো সে বুদ্ধিমান, পড়ালেখায় খারাপ তো তার বুদ্ধিই নেই। কিন্তু আমি বলবো, পড়ালেখায় ভালো হওয়াটা বুদ্ধিমত্তার স্রেফ একটা অংশ। এছাড়াও অনেক কিছু আছে, যেগুলো না জেনে শুধু পড়ালেখায় ভালো হলে তাদের দিয়ে পৃথিবীর খুব বেশি উপকার আসলে হয়ই না! তাই আমি স্বপ্ন দেখি, বাংলাদেশের সবাই পড়ালেখার পাশাপাশি অন্যান্য সহশিক্ষামূলক কাজেও উদ্বুদ্ধ হবে।সত্যি বলতে কি, বাংলাদেশে পড়ালেখাটা আসলে মোটেও আনন্দের না। কিন্তু সেটিকে যদি আনন্দময় করে তোলা যেত, শিক্ষার্থীরা যদি হাসতে হাসতে শিখতো, তাহলে ব্যাপারটা অসাধারণ হতো না? আমাদের এই স্বপ্নগুলো পূরণ হলে আমরা এমন এক বাংলাদেশ দেখবো, যেখানে ছাত্রছাত্রীরা আনন্দের সাথে শিখছে। ভাবতেই কি দারুণ লাগে, তাই না?
0 মন্তব্যসমূহ