টিনের ক্যানে স্বপ্ন পুঁতে রেখেছিল যেই মানুষটি


(সুপারহিরোদের বিচরণ আমাদের কল্পনার জগতেই সীমাবদ্ধ। কিন্তু আমাদের চারপাশেই এমন সব মানুষ রয়েছেন, হার না মানা সংকল্প প্রচেষ্টার বলে যারা কল্পনার অতিমানবদেরও ছাড়িয়ে যান। আসুন, পরিচিত হই পৃথিবী বদলে দেওয়া এই মানুষগুলোর সাথে, সীমিত গন্ডিবদ্ধ জীবনে যাদের গল্প একরাশ অনুপ্রেরণায় স্ফূর্ত করে তুলবে আপনার হৃদয়।)
২০১১ সালে মিডিয়া ব্যক্তিত্ব অপরাহ উইনফ্রে যখন তাঁর বিশ্বনন্দিতদি অপরাহ উইনফ্রে শোএর সুদীর্ঘ পঁচিশ বছরের যাত্রার ইতি টানেন, তখন তাঁকে জিজ্ঞেস করা হলো- এই পঁচিশ বছরে তাঁর টক-শো তে যারা অতিথি হয়ে এসেছেন, তাঁদের মাঝে তাঁর সবচেয়ে পছন্দের অতিথিটি কে? সবাইকে অবাক করে দিয়ে অপরাহ বলেন, “Tererai Trent!” শুনতে অবাক লাগছে, তাই না?
পঁচিশ বছরে অপরাহ এর শো তে অজস্র বরেণ্য ব্যক্তিবর্গ অতিথি হয়ে এসেছেন, যাদের মাঝে প্রেসিডেন্ট, সম্রাজ্ঞী, হলিউডের নায়ক থেকে শুরু করে এমন কেউ নেই যে ছিলেন না। সুতরাং এত জগদ্বিখ্যাত অতিথিবর্গের মাঝে থেকে অপরাহ যখন অখ্যাত এই মানুষটিকে বেছে নিলেন সবচেয়ে প্রিয় অতিথি হিসেবে, সবার মনে তখন প্রশ্ন জাগলো, কে এই ‘Tererai Trent’? কোন কীর্তির বলে তিনি এত বাঘা বাঘা তারকাদের টপকে শ্রেষ্ঠ অতিথি হিসেবে অপরাহ মনে জায়গা করে নিয়েছেন?
চলুন পাঠক! জেনে নেওয়া যাক জিম্বাবুয়ের এক প্রত্যন্ত গ্রাম থেকে উঠে এসে কিভাবে বিশ্বজুড়ে আলোড়ন সৃষ্টি করলেন এই স্বপ্নদ্রষ্টা নারী তার গল্প।

মীনা কার্টুনএর সেই মিনা যখন বাস্তবে

টেরেরাহ ট্রেইনটের জন্ম জিম্বাবুয়ের এক নিতান্ত অজপাড়াগাঁয়। আজন্ম শৈশব তার দারিদ্র্যের হাত ধরে পথচলা। যে কুঁড়েঘরে তার পরিবারের আবাস, সেখানে না ছিল সুখ স্বাচ্ছন্দ্য, না ছিল একটি সুন্দর ভবিষ্যতের স্বপ্ন দেখার সাহস।
ছোট্ট টেরেরাহ খুব অল্প বয়সেই জীবনের রূঢ় বাস্তবতার সাথে পরিচিত হন। পড়ালেখার প্রতি তার ছিল ভীষণ আগ্রহ। কিন্তু তার বাবা বাধ সেধে বলেন, পড়ালেখা ছেলেদের কাজ, মেয়েদের পড়ালেখা করানো সময় অর্থের অপচয়। সুতরাং ভাই তিনাশে যখন ব্যাগ কাঁধে নিয়ে স্কুলে যাচ্ছে, বেচারী টেরেরাহ তখন মায়ের সাথে রান্নাঘরে চুলায় হাঁড়ি চড়াতে ব্যস্ত। কিন্তু তাই বলে তিনি হাল ছেড়ে দেওয়ার পাত্র নন। সবার চোখ এড়িয়ে চুপিচুপি তিনাশের বই খাতা পড়ে শেখা শুরু করলেন। কিছুদিনের মধ্যেই টেরেরাহ এত পারদর্শী হয়ে উঠলেন যে তিনি ভাইকে ছাড়িয়ে গেলেন পড়ালেখায়! তিনাশে যখন বাইরে ফুটবল খেলতে ব্যস্ত, টেরেরাহ তখন গভীর মনোযোগে ভাইয়ের হোমওয়ার্ক করে দিতে লাগলেন ঘরে বসে।
এদিকে তিনাশের স্কুলে তার শিক্ষকেরা পড়লেন গভীর ধন্দে। তিনাশে ক্লাসে ভীষন অমনোযোগী ছেলে, কিন্তু তার হোমওয়ার্কগুলো ক্লাসের সেরা ছাত্রটিকেও লজ্জায় ফেলে দিচ্ছে! একটু খবর নিতেই বেরিয়ে পড়লো থলের বিড়াল। শিক্ষকেরা স্তম্ভিত হলেন ছোট্ট টেরেরাহর অসাধারণ মেধা পড়ালেখার প্রতি তীব্র আগ্রহের পরিচয় পেয়ে। তাঁরা সবাই মিলে তখন গেলেন টেরেরাহর বাবার কাছে, সবার অনুরোধে টললো বাবার মন। পূরণ হলো ছোট্ট টেরেরাহর কাঁধে ব্যাগ ঝুলিয়ে স্কুলে যাওয়ার স্বপ্ন!
এই ক্যানের ভেতর আছে স্বপ্ন! যে স্বপ্ন আমাকে বিশটি বছর ঘুমাতে দেয়নি!

গরুর বিনিময়ে বিয়ে

খুব বেশিদিন টেরেরাহর কপালে এই সুখ সইলো না। তার বাবা অভাব দূর করতে একটি গরুর বিনিময়ে মেয়েকে তুলে দিলেন পাত্রপক্ষের হাতেটেরেরাহর মাথায় আকাশ ভেঙে পড়লো। শ্বশুরবাড়িতে তার বিন্দুমাত্র স্বাধীনতা ছিল না। পড়ালেখার সুযোগ চাইলে স্বামীর হাতে বেদম প্রহৃত হতেন। মাত্র আঠার বছর বয়সেই টেরেরাহর কোলে এলো তিন সন্তান, গ্রামের আর সব মেয়েদের মতোই সব স্বপ্ন জলাঞ্জলি দিয়ে সারাদিন ঘরের কাজ সন্তানের লালনপালনে কেটে যেতে লাগলো তার দিনগুলো।

পুঁতে রাখা স্বপ্নের বীজ

হয়তো এখানেই যবনিকা নামতো টেরেরাহর গল্পের, কিন্তু একটি ঘটনায় বদলে গেলো তার জীবনের মোড়। Jo Luck নামে একজন বিখ্যাত নারী উদ্যোক্তা তাদের গ্রাম সফরে এসেছিলেন। তিনি গ্রামের সব নারীকে একত্রিত করে প্রশ্ন করলেন, “তোমার জীবনের সবচেয়ে বড় স্বপ্নটি কি?” এই কথাটি টেরেরাহর মনে ভীষণভাবে গেঁথে গেল। যেই ভাবা সেই কাজ, ঠিক করে ফেললেন জীবনের সবচেয়ে বড় স্বপ্ন- যুক্তরাষ্ট্রে যাওয়া, ব্যাচেলর্স, মাস্টার্স এবং সর্বশেষ পিএচডি সম্পন্ন করা।
একটি কাগজে গুটিগুটি অক্ষরে লিখে ফেললেন স্বপ্নগুলো, তারপর একটা টিনের ক্যানে ভরে পুঁতে রাখলেন মাটির গভীরে। স্বপ্নগুলো মাটিচাপা পড়ে রইলো, কিন্তু সে স্বপ্নের বীজ রয়ে গেল হৃদয়ের গভীরে।

ধাপে ধাপে আলোর দেখা

টেরেরাহর প্রথম স্বপ্নটি পূরণ হয় ১৯৯৮ সালে, যখন স্বামী পাঁচ সন্তান নিয়ে যুক্তরাষ্ট্রের ওকলাহোমায় পাড়ি জমান তিনি। নতুন পরিবেশে নিদারুণ সংগ্রামের ভেতর দিয়ে যেতে হয় তাকে, তবু সবদিক সামলে তিনি যুক্তরাষ্ট্রে যাওয়ার তিন বছরের মাথায় ব্যাচেলর ডিগ্রি অর্জন করেন। স্বামীর নির্যাতন সময় চরমে ওঠে। টেরেরাহ সিদ্ধান্ত নেন, অনেক হয়েছে, আর মুখ বুজে অত্যাচার সহ্য নয়। স্বামীকে ডিভোর্স দেন তিনি, তীব্র পারিবারিক কলহের মাঝেও পড়ালেখা চালিয়ে ২০০৩ সালে অর্জন করেন মাস্টার্স ডিগ্রি।
প্ল্যান্ট প্যাথোলজিস্ট মার্ক ট্রেন্ট কে বিয়ে করার মাধ্যমে শুরু হয় তার জীবনের এক নতুন অধ্যায়।

স্বপ্ন যাবে বাড়ি

অবশেষে সেই মাহেন্দ্রক্ষণ এলো ২০০৯ সালে, ওয়েস্টার্ন মিশিগান ইউনিভার্সিটি থেকে তিনি পিএচডি সম্পন্ন করেন! তার জীবনের সবচেয়ে সেরা স্বপ্নটি আজ ছোঁয়া হয়েছে, এবার সময় এসেছে বাড়ি ফেরার। টেরেরাহ তার পরিবার নিয়ে জিম্বাবুয়ের গ্রামে তার সেই কুঁড়েঘরটিতে ফিরে গেলেন। কিন্তু আঠারো বছর আগে টিনের ক্যানে স্বপ্ন পুঁতে রেখেছিল যে মেয়েটি, সে ছিল একদম একা, অসহায়। আজকের ডক্টরেট ডিগ্রিধারী নারীটি অনেক পরিণত, পৃথিবীর এপার ওপার বিজয় করা হয়ে গেছে তার। সমগ্র গ্রামবাসীকে সাথে নিয়ে ধীরপায়ে এগিয়ে চলেন তিনি, দুরুদুরু উত্তেজনায় কাঁপছে তার বুক। এদিক ওদিক কি যেন খুঁজে বেড়ায় তার চোখ, বহু বছরের পরিক্রমায় সবকিছু অনেক বদলে গেছে, তবু জায়গাটি ঠিক খুঁজে পান তিনি। স্বামী, সন্তান শত শত গ্রামবাসীদের সামনেই ছুটে যান মাঠের প্রান্তরে, খুঁড়তে থাকেন মাটি। সবাইকে বিস্মিত করে ধুলোবালিমাখা একটি টিনের ক্যান বের করে আনেন তিনি গর্ত থেকে।কি এমন আছে ওই ক্যানের ভেতর টেরেরাহ?” জানতে চায় সবাই।
টেরেরাহর চোখে অশ্রুর ধারা নামে। বাষ্পরুদ্ধ কণ্ঠে বলেন, “এই ক্যানের ভেতর আছে স্বপ্ন! যে স্বপ্ন আমাকে বিশটি বছর ঘুমাতে দেয়নি!”

অপরাহ উইনফ্রেহর সবচেয়ে প্রিয় অতিথি

২০১১ সালে টেরেরাহ ট্রেন্ট যখন অপরাহ শো তে আমন্ত্রিত হয়ে আসেন, তিনি ঘুণাক্ষরেও ভাবননি তার জন্য কি বিস্ময় অপেক্ষা করছে! অপরাহ টেরেরাহকে নির্বাচিত করেন তার সর্বকালের সেরা অতিথি হিসেবে, এবং তার স্বপ্নের স্কুলের জন্য দেড় মিলিয়ন ডলার ডোনেট করেন!
এই স্বপ্নের স্কুলের নির্মাণকাজ শেষ হয় ২০১৪ সালে। আজ জিম্বাবুয়ের সেই গ্রামটিতে নিরক্ষর কোন শিশু নেই। কোন মেয়েকে আজ শিক্ষার অধিকার থেকে বঞ্চিত হতে হয়না। স্কুলের হাজারো শিক্ষার্থী সবাই যেন গ্রামটিকে আলোকিত করে রেখেছে। শিশুদের কলকাকলিতে মুখরিত স্কুল প্রাঙ্গনে দাঁড়িয়ে টেরেরাহ ভাবেন, “এই তো সত্যি হলো আমার স্বপ্ন! যখন আমি স্বপ্নটি দেখেছিলাম, তখন আমার সাথে কেউ ছিল না, অথচ আজ সমগ্র বিশ্ব এসে দাঁড়িয়েছে পাশে! জীবদ্দশাতেই আমার সবগুলো স্বপ্ন বাস্তবে রূপ নিয়েছে, আমার চেয়ে সৌভাগ্যবান আর কে হতে পারে?!”
সত্যিই তো, স্বপ্ন দেখতে জানা মানুষগুলোর চেয়ে সুখী আর কেউ কি হতে পারে?

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

0 মন্তব্যসমূহ