হোঁচট খেয়ে উঠে দাঁড়ানো মানুষগুলো


“There is no elevator to success, you have to take the stairs” – Zig Ziglar
উপরের এই উক্তিটি আমাদের মত সাধারণ মানুষদের জন্য যতটা সত্য ঠিক ততটাই সত্য পৃথিবীর সব বিখ্যাত মানুষদের জন্য। অনেক সময় অনেকের খ্যাতি দেখে আমরা হয়ত অজান্তেই বলে উঠি, “ইস! আমি যদি পারতাম হতে!” কিন্তু কখনো কি ভেবেছি এই মানুষটা জীবনে কতটুকু কষ্ট করেছে? যে নাম আজকে পুরো বিশ্বকে ঘুরিয়ে দিতে পারে, কখনো কি সে নামের পেছনের গল্পটা জানতে চেয়েছি? আজকে সেরকমই ছয়জন মানুষের গল্প খুব সংক্ষেপে বলব।

১। অপরাহ উইনফ্রে

এই শতাব্দীর শীর্ষস্থানীয় অনুষ্ঠানগুলোর মধ্যে অন্যতম ‘The Oprah Winfrey Show’ খ্যাত অপরাহ উইনফ্রে কে চেনেননা এমন মানুষ পৃথিবীতে খুঁজলে হয়ত কমই পাওয়া যাবে। অপ্রাহ বিংশ শতাব্দীর সর্বোচ্চ ধনী মার্কিন-আফ্রিকান হিসেবে আখ্যায়িত। বর্তমানে তিনি উত্তর আমেরিকার প্রথম এবং একমাত্র মাল্টি-বিলিওনিয়ার কৃষ্ণাঙ্গ হিসেবে পরিচিত। অথচ তাঁর চলার পথটা কিন্তু কখনোই মসৃণ ছিলনা। অপ্রাহ উইনফ্রে, Queen of all media- এর জন্ম মিসিসিপির এক নিতান্ত দরিদ্র পরিবারে। তাঁর মা ছিলেন  গৃহপরিচারিকা, বাবা ছিলেন নাপিত। মা-বাবার বিচ্ছেদের কারণে জন্মের পরপরই তাঁর আশ্রয় হয় নানির কাছে যেখানে দারিদ্র্যের জন্য তাঁকে পোষাকের বদলেআলুর বস্তাপড়ে সমবয়সীদের হাসির পাত্র হতে হয়।
বিশ্বের সকল সফলতার গল্পের পেছনেই কিন্তু একটা করে ব্যর্থতার গল্প রয়েছে।
জীবনে কখনো হোঁচটই যদি না খেলেন তবে উঠে দাঁড়াবেন কি করে?
এরপর মাত্র নয় বছর বয়স থেকে তিনি আশেপাশের মানুষদের থেকে নিগৃহীত হতে থাকেন এছাড়াও এই অল্পবয়সেই তাঁকে সাক্ষী হতে হয় অনেক কাছের মানুষের করুণ মৃত্যুর। এত কিছুর পরও, কিশোরী বয়সেই অপ্রাহ নিজ যোগ্যতায় বিভিন্ন অনুষ্ঠান উপস্থাপনার চাকরী  পেয়ে যান কিন্তু তা তাঁর জন্য তেমন একটা সুখকর হয়না কেননা, বাল্টিমোরে তাঁর প্রথম চাকুরি থেকে বিনা দোষে তাঁকে বহিষ্কার করা হয়। সকল অভিজ্ঞতা থেকে অনুপ্রাণিত হয়েই হয়ত অপ্রাহ বলেছেন, “There is no such thing as failure. Failure is just life trying to move us in another direction.” (২০১৫ সালের হার্ভার্ড বিশ্ববিদ্যালয়ে প্রদত্ত এক বক্তৃতায়)

২। ওয়াল্ট ডিজনি

মিকি মাউস, ডোনাল্ড ডাককে ছাড়া কি আমরা আমাদের শৈশবকে কল্পনাও করতে পারি? কিন্তু আমাদের শৈশবকে সুন্দর করা Walt Disney স্টুডিওর প্রতিষ্ঠাতা ওয়াল্ট ডিজনির ক্যারিয়ারের শুরুটা কিন্তু সুন্দর ছিলনা। Kansas City Star নামক পত্রিকার সম্পাদক তাঁকে পত্রিকার চাকরী থেকে বহিষ্কার করেন এই অজুহাতে যে, ‘তাঁর কল্পনাশক্তির ঘাটতি রয়েছে এই ঘটনার দুবছর পর তিনি Laugh-O-Gram নামক ফিল্ম স্টুডিও প্রতিষ্ঠা করে দেউলিয়াত্বের শিকার হন। এতে কিন্তু তাঁর পথচলা থেমে থাকেনি। দেউলিয়াত্বের পরও অবিশ্বাস্যভাবে সফল হয়ে তিনি বলেছেন, “It’s kind of fun to do the impossible” আর তাঁর এই সফলতাই আমাদের শেখায় যে, “If you can dream it, you can do it!”

৩। থমাস আলভা এডিসন

আমাদের চারপাশকে আলোকিত করা লাইট বাল্ব, মোশন পিকচার ক্যামেরা এবং ফোনোগ্রাফের উদ্ভাবক এডিসনের শৈশব ছিল খুবই নিষ্প্রভ। ছোট থাকতে তাঁকে স্কুল থেকে Addled অর্থাৎ মানসিকভাবে অসুস্থ এবংToo stupid to learn anything’  বলা হয় যে কারণে তাঁর মা তাঁকে স্কুল থেকে সরিয়ে তাঁর জন্য গৃহশিক্ষার ব্যবস্থা করেন। এমনকি, পরবর্তীতেও এডিসন কোন প্রকার প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা লাভ করেননি।অনুৎপাদকআখ্যা দিয়ে তাঁকে পর পর দুজায়গা থেকে চাকরীচ্যুত করা হয়। লাইট বাল্ব আবিষ্কারের সময় তিনি ১০০০ বার অসফল হন! সম্পর্কে এক সাক্ষাৎকারে তিনি বলেন, “I didn’t fail 1,000 times. The light bulb was an invention with 1,000 steps.” এডিসনের নামে ১০৯৩ টি মার্কিন প্যাটেন্ট রয়েছে।

৪। থিয়োডোর গাইসেল সেউস

ছোটবেলায় আমরা অনেকেই ‘The Cat in The Hat’ নামের একটা বই পড়েছি কিংবাHow Grinch Stole  Christmas’ বইটা। এরকম প্রচুর চমৎকার বইয়ের লেখক . সেউসের প্রথম বই ‘And to Think That I Saw It on Mulberry Street’ (১৯৩৭) শুরুতে ২৭ জন ভিন্ন ভিন্ন প্রকাশকের দ্বারা প্রত্যাখ্যাত হয়েছে! কিন্তু পরবর্তীতে এই বইটিরই ৬০০মিলিয়নেরও অধিক কপি বিক্রি হয়েছিল। আমাদের উদ্দেশ্যে তাঁর করা অনেকগুলো উক্তির মাঝে একটি হচ্ছে, “Just tell yourself, Duckie, you’re really quite lucky!”( From the book-Did I Ever Tell You How Lucky You Are?)

৫। আলবার্ট আইনস্টাইন

আইনস্টাইনের জীবনটাও অনেকটা এডিসনের মত। E=mc2  সূত্রটির আবিষ্কারক আইনস্টাইন নয় বছর বয়স পর্যন্ত ঠিক মত কথাই বলতে পারতেন না যে কারণে স্কুলের শিক্ষকরা তাঁকে পিছিয়ে পড়া শিক্ষার্থী হিসেবে গণ্য করত। শিক্ষাজীবনের রেকর্ড খারাপ হওয়ায় লেখাপড়া শেষে চাকরী জোটাতেও তাকে কষ্ট করতে হয়। অবশেষে চাকরী পাওয়ার পর তাঁর বেতন অনুকূলে না থাকায় তিনি স্ত্রী-সন্তানের ভরণ পোষণ দিতে পারতেন না যে কারণে ব্যক্তিজীবনে তিনি অনেকটা নিঃসঙ্গ ছিলেন। কিন্তু এসব প্রতিকূলতা তাঁর গবেষনাকে দমিয়ে রাখতে পারেনি। তাঁর মতে, “You never fail until you stop trying. অদম্য পরিশ্রম দিয়ে তিনি নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করেছেন পৃথিবীর শ্রেষ্ঠতম বিজ্ঞানী হিসেবে।

৬। কর্নেল স্যান্ডার্স

স্যান্ডার্স আমার অনেক প্রিয় একজন মানুষকেন তা পরে বলছি। স্যান্ডার্স বছর বয়সে তাঁর বাবাকে হারান। ১৬ বছর বয়সে লেখাপড়া থামিয়ে দিয়ে মাত্র ১৭ বছর বয়সেই বার চাকরীচ্যুত হন। তিনি সেনাবাহিনীতে যোগ করেও ব্যর্থ হন, ব্যর্থ হন রেললাইনের কন্ডাক্টার, বীমাপত্র বিক্রেতা, অগ্নিনির্বাপক হিসেবেও। ৬৫ বছর বয়সে তিনি অবসরে যাওয়ার পর তাঁর হাতে থাকে মাত্র ১০৫ ডলার। জীবনের সব  আশা ছেড়ে দিয়ে স্যান্ডার্স আত্মহত্যা করার আগ মুহূর্তে জীবনের অর্জনগুলোর লিস্ট করতে গেলে তাঁর মনে হয় যে, না! এখনও অনেক কিছু করা বাকি! তখনই তিনি ১০৫ ডলারের সাথে ধারকৃত আরো কিছু ডলার যোগ করে তাঁর গোপন রেসিপি দিয়েচিকেন ফ্রাইবানানো শুরু করেন। কিন্তু সেই চিকেন ফ্রাই রেস্টুরেন্টে বিক্রি করতে গেলে মোট ১০০৯ জন বলেন যে তিনি পাগল হয়ে গেছেন! পরে তিনি নিজ উদ্যোগে বাড়ী বাড়ী গিয়ে চিকেন ফ্রাই বিক্রি শুরু করেন এবং এই মানুষটাই হচ্ছেন বিখ্যাত ফাস্টফুড শপ ‘Kentucky Fried Chicken(KFC)’ প্রতিষ্ঠাতা সেই সাদা স্যুট এবং বো টাই পড়া ভদ্রলোক!
জীবনে চলার পথটা কিন্তু কারো জন্যই মসৃন নয়। শুধু এই ছয়জন নয়, বিশ্বের সকল সফলতার গল্পের পেছনেই কিন্তু একটা করে ব্যর্থতার গল্প রয়েছে। জীবনে কখনো হোঁচটই যদি না খেলেন তবে উঠে দাঁড়াবেন কি করে? মনে রাখবেন,
It is never too late to follow your dream
And there is no time like now to begin

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

0 মন্তব্যসমূহ