চাওয়া এবং পাওয়ার মাঝে একটি ফারাক থাকে, আমাদের সুখ–দুঃখের অনুভূতিগুলো নিয়ন্ত্রণ করেসেটি। প্রত্যাশার সাথে বাস্তবতা পুরোপুরি মিলবে না কখনোই, কিন্তু তাই বলে সেটি নিয়ে মন খারাপকরারও কোন মানে হয় না।
আমাদের প্রজন্মের সবচেয়ে বড় সমস্যা– আমাদের কিছুই ‘ভাল্লাগে না‘। কোনকিছুতে আনন্দ পাই নাআমরা, কিছু দিয়েই সন্তুষ্ট করা যায় না আমাদের। কেন এই নেতিবাচক প্রবণতা?
অনলাইন এবং অফলাইন
একসময় প্রতি পাড়ায় পাড়ায় তরুণদের ক্লাব ছিল। সাংস্কৃতিক সংঘ, খেলাধুলার ক্লাব, লাইব্রেরি, সমাজসেবা ইত্যাদি। এখন মানুষে মানুষে সেই হৃদ্যতা আর নেই। আমাদের বন্ধু বেড়েছেঅনেক, কিন্তু সেটি অনলাইনে। হৃদ্যতার প্রকাশ এখন লাইকে, কমেন্টে।
ফেসবুকে ছবিতে কয়টা লাইক উঠলো, কমেন্ট আসলো সেটার উপর মন ভাল থাকা না থাকা নির্ভরকরে অনেকের! ভার্চুয়াল জগতের অবাস্তব একটা প্রতিযোগিতার জগতে ডুবে আছি আমরা।ফেসবুকে ঢুকলেই বন্ধুর সাফল্যের খবর, অমুকের চাকরি পাওয়ার খবর, তমুকেরা দল বেঁধে বেড়াতেগেছে তার ছবি– এসব দেখতে দেখতে মনে হয়, আমি কী করছি বসে বসে?
আমরা ভুলে যাই, অনলাইনে আমরা অন্যদের জীবনের হাইলাইটসগুলো শুধু দেখতে পাই।বাস্তব জীবনে কেউই প্রতি মুহূর্ত অনেক সাফল্য, আনন্দ, উত্তেজনায় কাটায় না। খেয়াল করলেদেখবে, তোমার বন্ধুটিও ফেসবুকে তোমার ছবি দেখে ভাবে, “ইস, ও কতোই না মজায় আছে!”
সবচেয়ে দুঃখের বিষয় হচ্ছে, অনলাইনের এত বন্ধু এত আড্ডা, গল্প– অফলাইনে আসলেই কেউ আরনেই সাথে! লাইক–কমেন্ট–ফলোয়ারের এই অসুস্থ অর্থহীন প্রতিযোগিতা ছেড়ে বাস্তবে একজনসত্যিকারের বন্ধু খুঁজে নাও, ভাল থাকবে অনেক।
” Follow your passion” এর প্রহেলিকা
গত পঁচিশ বছরে পৃথিবীতে সবচেয়ে বেশি যেই কথাটি আওড়ানো হয়েছে তা হচ্ছে–
“Follow your passion!” কথাটির গুরুত্ব অস্বীকার করবার নয়, প্রচলিত ধারার বাইরে গিয়ে নিজের স্বপ্নের পিছে নাছুটলে আমরা মার্ক জাকারবার্গ, এ. আর. রহমান, সাকিব আল হাসান এদের পেতাম না। কিন্তু প্রশ্নহচ্ছে, আসলেই কি তোমার কোন প্যাশন আছে?
“আমি ফুটবল খেলতে ভালবাসি, আমি ভিডিও গেমসে এক্সপার্ট ইত্যাদি ইত্যাদি”
দুঃখিত, এগুলো অনুসরণ করার মতো প্যাশন নয়। সাকিব–তামিমের গল্প শুনে আমরা খেলোয়াড়হওয়ার স্বপ্নে বিভোর হই, কিন্তু একজন সাকিবের সাফল্যের পেছনে যে হাজার হাজার নাম না জানামানুষের ব্যর্থতার গল্প ঢাকা পড়ে আছে সেটা আমাদের চোখ এড়িয়ে যায়।
তোমার যদি অসম্ভব ট্যালেন্ট থাকে প্যাশনের ক্ষেত্রটিতে, তাহলে সেটার সাথে কঠোর পরিশ্রম আরসাধনা মিলে সত্যি সত্যি একটা কিছু হওয়া সম্ভব তোমার পক্ষে। কিন্তু ৯৫% মানুষ এত সৌভাগ্যবাননয়, “খেলতে ভাল লাগা” আর “খেলোয়াড় হওয়া“র মাঝে যে আকাশ পাতাল পার্থক্য আছে, সময়থাকতে তারা সেটি ধরতে পারে না।
তাই তোমার যদি মন খারাপ হয় এ কারণে যে, বাবা–মা সারাক্ষণ পড়ালেখার জন্য জোর দেন, তোমার‘প্যাশন‘কে অনুসরণ করতে উৎসাহ দেন না, আমি তাদের সিদ্ধান্তকে সমর্থন করি। তারা তোমারনিরাপত্তা চান, খেয়ে-পরে বাঁচার মতো একটা ক্যারিয়ার যেন পেতে পারো সেটা নিশ্চিত করতে চান।
তাহলে কীভাবে প্যাশনকে অনুসরণ করবে?
তোমাকে প্রমাণ করতে হবে যে তুমি সেই ভাগ্যবান ৫% এর একজন, প্যাশন অনুসরণ করে তোমারসত্যিই বড় কিছু করার সম্ভাবনা রয়েছে।
এডমিশনের সময় বাবা–মার ইচ্ছে ছিল আমাকে মেডিকেলে পড়ানোর। কিন্তু আমার ইচ্ছে ছিলআইবিএতে পড়ার। বাংলা মিডিয়াম ব্যাকগ্রাউন্ড, আইবিএতে চান্স পাওয়ার সম্ভাবনা কম ইত্যাদিইত্যাদি শুনতে হয়েছে সবসময়। এখন দুটি অপশন হাতে ছিল–
১. বাবা–মা জোর করে চাপিয়ে দিয়েছেন মেডিকেল- এটা ভেবে বিষণ্ণতায় ভোগা।
২. আমি সত্যিই আইবিএতে পড়ার যোগ্যতা রাখি সেটা প্রমাণ করা।
কোচিংয়ে প্রত্যেকটা পরীক্ষায় দুর্দান্ত ফলাফল করার মাধ্যমে তাঁদেরকে বিশ্বাস করানো সম্ভব হয়েছিলযে– হ্যাঁ, আইবিএতে আমাকে দিয়ে হবে!
সুতরাং তোমার যদি কোন প্যাশন থাকে, বাবা–মা সেটিকে পাত্তা না দিয়ে অন্য কিছু চাপিয়ে দিতেচান, সেটা নিয়ে মন খারাপ করার প্রশ্নই আসে না। প্রচলিত ধারার বাইরে গিয়ে ক্যারিয়ার গড়া ভীষণকঠিন কাজ, তাঁরা তো চাইবেনই তুমি যেন একটি নিরাপদ ক্যারিয়ারে থাকো। তোমাকেপারফর্ম্যান্স দিয়ে প্রমাণ করতে হবে যে, প্যাশন অনুসরণ করে তুমি সফল হওয়ার সামর্থ্যরাখো। It’s
DO or DIE, “চেষ্টা করেছি“-র কোন সুযোগ নাই।
বাবা–মাকে দেখে শেখো
আমাদের অনেকেরই বাবা–মার উত্থান গ্রামাঞ্চল থেকে, সেখানে না ছিল পড়ালেখার পরিবেশ, নাছিল কোন সুযোগ–সুবিধা। সেই অবস্থা থেকে কঠোর সংগ্রাম আর অধ্যবসায়ের মাধ্যমে তাঁরাআজকের অবস্থানে উঠে এসেছেন।
আমরা যেই সুযোগ–সুবিধা পেয়ে বড় হচ্ছি সেটা তাঁরা কল্পনাও করতে পারেননি তাঁদের সময়ে।তাঁদের লক্ষ্য ছিল একটাই– জীবনটাকে সুন্দর করে গুছিয়ে নেওয়া, একটা সম্মানজনক অবস্থানেপৌঁছানো।
তোমার জীবনের লক্ষ্য কী?
জীবনযুদ্ধ কাকে বলে সে সম্পর্কে আমাদের বেশিরভাগেরই বিন্দুমাত্র ধারণা নেই। আমাদেরদুঃখগুলো হচ্ছে “সবাই ট্রিপে যাচ্ছে আর আমি ঘরে বসে আছি“, “ওজন বেড়ে যাচ্ছে, মানুষ মোটাবলে খোঁচা দেয়” এসব তুচ্ছ তুচ্ছ জিনিস নিয়ে!
খুব সহজ করে বলি, ধরো সাফল্য একটা বিল্ডিং, আমাদের বাবা–মায়েরা একদম শূন্য থেকে শুরুকরে, নিচতলা থেকে উঠা শুরু করে দশতলা পর্যন্ত এসেছেন। তুমি জীবন শুরুই করছো দশম তলাথেকে, তোমার অন্তত বিশতলা পর্যন্ত তো যাওয়া উচিত!
ভাল লাগবে তখনই, যখন সাফল্য দিয়ে সমালোচকদের মুখ বন্ধ করতে শিখবে
আমাদের লক্ষ্য হওয়া উচিত অনেক অনেক উপরে, আমাদের বাবা–মা দেশীয় পর্যায়ে সাফল্যএনেছেন, আমাদের লক্ষ্য থাকবে আন্তর্জাতিক পরিমণ্ডলে সফল হওয়ার।
ভাল লাগবে তখনই, যখন তুচ্ছ বিষয় নিয়ে মাথা ঘামানো বন্ধ করে কাজে ঝাঁপিয়ে পড়বে।
ভাল লাগবে তখনই, যখন সাফল্য দিয়ে সমালোচকদের মুখ বন্ধ করতে শিখবে।
যখন সবসময় অন্যদের সাফল্যে “congratulations!”,
“so proud of you” কমেন্ট করে আসা তুমিওআপন সাফল্যে সবাইকে ছাড়িয়ে যাবে।
জীবনটাকে উপভোগ করতে শিখবে তখনই, যখন জীবন হবে চ্যালেঞ্জিং। নিজের উপার্জনের টাকায়যেদিন বাবা–মাকে মন থেকে কিছু উপহার দিতে পারবে, দেখবে জীবনটাকে মনে হবে অনেকসুন্দর।


0 মন্তব্যসমূহ