জীবন! সে তো পদ্ম পাতার শিশির বিন্দু। গাছের পাতার ফাঁক দিয়ে একটু একটু করে প্রখর হওয়া ভোরের প্রথম আলোকরশ্মি কিংবা শীতের রাতে টিনের চালের টুপ-টাপ শব্দ – এইতো জীবন। স্বল্পায়ত, কিন্তু বড্ড বেশিই বৈচিত্র্যময়। বিয়ের আসরে সদ্য পা রাখা নববধূটির মত ‘জীবন’টাকেও সাজানোর জন্য কত প্রয়াস, কত ব্যস্ততা। এর মাঝেও ফেলে আসা মুহূর্তগুলোর জন্য একবার হলেও সবাই পিছনে তাকায় আর অবাক হয়ে আবিষ্কার করে স্মৃতির অ্যালবাম সাজিয়ে বসে থাকা সুবিন্যস্ত অপেক্ষমান স্মৃতিগুলোকে।
বুকের সংগোপনে লুকিয়ে রাখা এক অনন্য ‘Dreamland’!
স্কুল-কলেজ জীবনে ‘রচনা’ কিংবা ‘Composition’ লেখার
সবচাইতে পছন্দের বিষয় ছিল ‘শৈশব স্মৃতি’ বা ‘Childhood Memories’। আজও মনে পড়ে, প্রশ্নপত্র পেয়ে সবার আগে দেখতাম রচনার অংশটা। আর সেখানে কাঙ্ক্ষিত পছন্দের বিষয়টা থাকলে তো কথাই নেই। অদ্ভুত এক হাসি ফুটে উঠত মুখে। প্রিয় বিষয় নিয়ে লিখতে লিখতে কখন যে স্মৃতির গহীনে হারিয়ে যেতাম, টেরই পেতাম না।
স্মৃতির
ছেঁড়া পাতা
‘শৈশব’ বলতেই
মনে
পড়ে
হাজারটা রঙিন-মলিন স্মৃতিমাখা অবাধ
স্বাধীনতার অসাধারণ কিছু
দিনের
কথা।
বাবা-মায়ের আদর-শাসনভরা মুহূর্তগুলো, বোনদের
সাথে
পড়ার
টেবিলে
করা
খুনসুটি, দাদুভাইয়ের সাথে
খেলা
‘মারামারি-মারামারি’, ছুটি
হলেই
দাদা-নানাবাড়ি যাওয়ার তীব্র আনন্দ- আরো
কত
কী।
সেই
ছেলেবেলা থেকেই
থাকতাম
সাগরের
খুব
কাছেই,
চট্টগ্রামের পতেঙ্গায়। সুযোগ
পেলেই
ফুফুরা
সহ
সবাই
মিলে
চলে
যেতাম
ঘুরতে।
ছবি
তোলার
জন্য
ঘোড়ার
পিঠে
চেপে
বসে
পোজ
দেওয়া
থেকে
শুরু
করে
নোনা
পানিতে
দাপা-দাপি আর ডিম-পরটা কিংবা চটপটি-
বাদ
যেত
না
কিছুই।
রাতে
কারেন্ট চলে
গেলে
মোমবাতির আলোয়
গোল
হয়ে
সাপলুডু খেলা
তো
আছেই।
এমন
কতশত
স্মৃতি
যে
হাতড়ে
হাতড়ে
বের
করা
যাবে
তার
ইয়ত্তা নেই।
ছিল
বটে
সেই
সব
দিনগুলো…।
অনাবিল
অফুরন্ত আনন্দের অকৃপণ
উৎস।
তিনটা জিনিস ভীষণ ভয় পেতাম ছেলেবেলায়। বজ্রের শব্দ, অ্যাম্বুলেন্সের তীক্ষ্ণ সাইরেন আর ‘উড়ন্ত’ তেলাপোকা। এখনও মনে পড়ে- তখন ছিল রাত। বাসায় অতিথি আপ্যায়নে ব্যস্ত বাবা-মা। ড্রয়িংরুমে বসে আছি। এমন সময় বাসার সামনের রাস্তা দিয়ে সাইরেন বাজিয়ে অ্যাম্বুলেন্স যাচ্ছে আর আমি বিছানায় মাথার উপর বালিশ চেপে চিৎকার করে কাঁদছি। আর বজ্রের শব্দ? এটার ভয় তো একটু বড় হওয়ার পরও ছিল। বিকট শব্দে বাজ পড়ত আর আমি ছোটছোট হাত দিয়ে আব্বু-আম্মু যাকেই পেতাম, জড়িয়ে ধরতাম। ‘উড়ন্ত’ তেলাপোকার কথা আর নাইবা বললাম।
পুরোনো নতুন শুরুর কথা
হাতেখড়ির দিনটির কথা বেশ মনে আছে আমার। বাবা-মা কোথাও থেকে শুনেছিলেন, “চার বছর, চার মাস, চার দিন বয়সে আনুষ্ঠানিক হাতেখড়ি সন্তানকে ‘বিদ্বান’ বানানোর অন্যতম অব্যর্থ উপায়”। যেই ভাবা, সেই কাজ। চার বছর, চার মাস, চার দিন বয়স আমার। হাফ প্যান্ট, হাফ শার্ট আর মাথায় টুপি পরিয়ে পাঠানো হল ড্রয়িংরুমে। যেয়ে আবিষ্কার করলাম লম্বা পাঞ্জাবি পরনে, কালো দাঁড়ির আর মাথায় বিশাল টুপি দেয়া একজন হুজুরকে; সামনে হরেক রকমের নাস্তা সাজানো। আশ-পাশ ঘিরে আছে কিছু পরিচিত-অপরিচিত মুখ। হুজুরের পাশে বসানো হল আমাকে। পড়ানো হল অ, আ, a, b, আলিফ, বা। এরপরই মিষ্টিমুখ। অতঃপর ‘ছাত্রজীবন’ এ আমার আনুষ্ঠানিক পদার্পণ।ইস্টার্ন রিফাইনারী মডেল হাই স্কুল। স্কুলজীবনের শুরুটা সেখানেই। ছিলাম সবে এক বছর, নার্সারিতে। ফ্যাকাশে হয়ে যাওয়া হলদে দালান, সামনে ছোটখাটো মাঠ, স্কুলের সাথে লাগানো পুকুরঘাট- চমৎকার ছিল পরিবেশটা। মাঠের এক পাশে জাতীয় পতাকা, তার সামনেই প্রতিদিন সকালে লাইন ধরে দাঁড়িয়ে সমস্বরে গাইতাম “আমার সোনার বাংলা, আমি তোমায় ভালোবাসি”। ২০০১ সালের কথা। নীল হাফপ্যান্ট, সাদা শার্ট, ডান বুকে নেমপ্লেট আর বামে স্কুলের ব্যাজ পরে সেই আঙিনায় প্রথম পা রেখেছিলাম বাবার হাত ধরেই। প্রথমেই নিয়ে গেলেন প্রধান শিক্ষকের রুমে। চশমা পরা, কাঁচা-পাকা দাঁড়ির প্রাণবন্ত সেই স্যার হাসতে হাসতে কিছু প্রশ্ন করলেন। এরপর পাঠিয়ে দিলেন ক্লাসরুমে। তেমন বেশি কিছু মনে নেই আর সেই দিনটার। শুধু মনে আছে, ক্লাসরুমের দরজায় দাঁড়িয়ে অবাক দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছি অপরিচিত কিছু মুখের দিকে আর তারচেয়েও বিস্ময়মাখা দৃষ্টিতে এক ঝাঁক ছেলেমেয়ে নির্বাক হয়ে দেখছে আমাকে। হাহাহাহাহা।
বাচ্চাকালের সেই সময়ে কোন এক বিচিত্র কারণে স্কুল আমার ভীষণ ভালো লেগে যায়। সেই ভালো লাগার উৎসটা আজ অব্দি খুঁজে পাই নি। স্কুলের বাইরে চিৎকার করে গাওয়া জাতীয় সংগীত, ক্লাসরুমের দক্ষিণ জানালার পাশের সেই আধভাঙ্গা সিট, মাঝে মাঝে রমা ম্যাডামের ক্লাসে গান গেয়ে শোনানো নাকি টিফিন ছুটিতে খেলা ‘বরফ-পানি’- কোনটার টানে যে সেই মোহের সূত্রপাত বলা মুশকিল।
খণ্ড খণ্ড স্মৃতি
“দপ্তরি ভাই, তবলা বাজাই;তবলার সুরে মৌমাছি ঘুরে ঘুরে-রে-রে-রে-রে…”
স্কুলের কথা যখন আসলই, দপ্তরি ভাই এর কথা না বললে তো লেখাটা কেমন যেন অপূর্ণ থেকে যায়। নামটা মনে পড়ছে না, কিন্তু চেহারাটা দিব্যি চোখে ভাসে আজো। কাঁচা-পাকা চুল, জমিদারি গোঁফ আর নীল রঙের ইউনিফর্ম পরা হাস্যোজ্জ্বল এক চেহারা। মনে হয়, এইতো সেদিন- জমিদারি গোঁফে হাত বুলাতে বুলাতে ডান হাতে পিতলের ঘণ্টা আর হাতুড়ি নিয়ে হেঁটে যাচ্ছিলেন স্কুলের বারান্দা দিয়ে। অতঃপর- ঢং ঢং ঢং ঢং ঢং……। সাথে সাথে চিৎকার করতে করতে এক ঝাঁক দুরন্ত ছেলেমেয়ের দৌড়ঝাঁপ শুরু। আহ্, সোনালী সেই দিনগুলো ছিল বটে!
তৃতীয় শ্রেণীতে পড়ি তখন। বার্ষিক পরীক্ষা। পরদিন বাংলা ২য় পত্র। তখন আমার কাছে বাংলা ২য় পত্র মানেই ‘রচনা’ নামক এক বিভীষিকার মুখোমুখি হওয়া। রচনা শিখেছিলাম দুটো- ‘ধান’ আর ‘পাট’; একটা আসবে নিশ্চিত। আগের দিন রাতে আম্মু বেশ ভালোভাবে বলে দিলেন কোন রচনা এসেছে ভালো করে দেখে তারপর লিখা শুরু করতে। পরদিন প্রশ্ন পেয়ে দেখি- ‘পাট’। আমি তো মহাখুশি। মহানন্দে লিখা শুরু করলাম। কিন্তু কিছুক্ষণ লিখেই আবিষ্কার করলাম, আমি আসলে ‘পাট’ লিখছি না, লিখছি ‘ধান’। সাথে সাথে কপালে চিন্তার বলিরেখা। কাটাকাটি করলে যে খাতাটা দেখতে সুন্দর লাগবে না! খাতার সৌন্দর্য রক্ষার্থে তাই ‘ধান’ লেখাই শ্রেয় মনে করলাম। অতএব খাতা দেওয়ার পর রচনায় প্রাপ্ত নম্বর ২০ এ ০৩…! সেই ‘বিচক্ষণতা’র কথা মনে পড়লে আজো হাসিতে ফেটে পড়ি।
স্মৃতিভাণ্ডারের এমন হাজারো স্মৃতি হাতড়ে বেড়াতে বেড়াতে অন্যমনস্ক হয়ে পড়ি। এ যেন এক অন্য জগত! বুকের সংগোপনে লুকিয়ে রাখা এক অনন্য ‘Dreamland’। যেখানে আরেকটিবার ফিরে যাওয়ার জন্য ব্যাকুল আকুতি সবার, কিন্তু…। চাইলেই কি সব হয়? ছোট থাকতে কত ভাবতাম, “ইস্, কবে যে বড় হব!” সেই ‘বড় হওয়া’ আজ সত্য বটে। কিন্তু এই এক বড় হওয়াই যেন নিয়ে গেল জীবনের অবাধ স্বাধীনতার চিন্তাহীন নির্মল এক অধ্যায়। তাই মাঝে মাঝেই ফিরে তাকাই, ফিরে তাকাতে হয়। ভাবতে হয় সেই সব দিনের কথা। কখনোবা ভাবতে ভাবতে ছলছল করে উঠে চোখ, কখনোবা অকস্মাৎ ফেটে পড়ি হাসিতে। তবুও সেসব মুহূর্তকে বুকের মাঝে আঁকড়ে ধরে ভালোই আছি। ভোলা তো যায় না আর……।
“পুরানো সেই দিনের কথা ভুলবি কি রে হায়;
ও সেই চোখের দেখা, প্রাণের কথা, সে কি ভোলা যায়”।
0 মন্তব্যসমূহ