পড়াশুনা ১০১

স্কুলে থাকতে এক টিচারের বাসায় প্রাইভেট পড়তাম, ফিজিক্স। স্যার অনেক ভালো ছিলো, পড়াতেনও বেশ। তিনি প্রায় প্রতিদিনই ক্লাস শেষে বলতেন “আজকে যা পড়ানো হলো, বাসায় গিয়ে ৫মিনিটের জন্য হলেও তা রিভাইস করবা, কেমন?” আমাদের হরহামেশাই তো শিক্ষকেরা এসব কথা বলেন, কিন্তু আমরা কয়জনই সেই ছোটবেলার “পড়াশুনার সময় পড়াশুনা, খেলার সময় খেলা”- এই আদর্শ মেনে চলি? ২-১ জন বাদে আমাদের প্রত্যেকেরই টনক নড়ে পরীক্ষার ৭-৮ দিন আগে, অনেকের ক্ষেত্রে তো সময়টা পরীক্ষার আরো কাছে। আমাদের সবার এই অবস্থা দেখে স্যার একদিন বলেছিলেন, “দোষটা কিন্তু সম্পূর্ণ তোমাদের না। বাকি দিনগুলোর চেয়ে পরীক্ষার আগের রাতেই কিন্তু আমরা সবচেয়ে বেশি জিনিস শিখি।”
স্যারের কথাটা কিন্তু ১০০ ভাগ সত্য। যেই টপিক আমি গত ১০-১২ দিন মাথার চুল ছিঁড়ে ফেলেও মাথায় ঢুকাতে পারিনি, সেই একই টপিক পরীক্ষার আগের রাতে নিমিষেই বুঝে ফেলি এবং পরবর্তীতে মনে হয়, “এত সহজ একটা টপিক এতদিন বুঝতে পারিনি? পরবর্তীতে আর এমনটা করা যাবে না একদম।” এবং প্রতিবারই আমাদের একই ভুলটা হয়। তুমি যদি মনে করে থাকো, পরীক্ষার আগের রাতেই সম্পূর্ণ সিলেবাস কভার করে একদম সেইরকম কিছু একটা করে ফেলাটা খুব বাস্তব ও একই সাথে সম্ভব, তা কিন্তু পুরোটাই ভুল। পরীক্ষার আগের রাতে হয়তো অনেক কিছুই দ্রুতই মাথায় ঢুকে, কিন্তু সেসব জ্ঞান কতটা টেকসই হবে, তা নিয়ে কিন্তু বিরাট সন্দেহ আছে। পরীক্ষার আগে কিংবা পুরো সেমিস্টার জুড়ে সিলেবাস শেষ করার টেনশন দূর করার উপায় কী তাহলে?
উপায় অবশ্যই আছে !
মূল প্রসঙ্গে যাওয়ার আগে একটা গল্প বলি। টনি রবিনস নামের এক ভদ্রলোক একবার তার বাচ্চার সাথে গলফ খেলতে গিয়েছিলেন। গলফ খেলার সময় গলফ বলটি হিট করার সঙ্গে বলটি সামনের লেকে গিয়ে পড়ে। তিনি দ্বিতীয়বার বলটি মারার পরেও বলটি পুনরায় লেকে পতিত হয়। পরবর্তী ৫-৬ বারও তার সাথে একই ঘটনা ঘটে, কিছুতেই তিনি বলটিকে হোলের মধ্যে ফেলতে পারছিলেন না। তিনি সঙ্গে সঙ্গে তার ইন্সট্রাকটরকে ডেকে বলেন, “এটা তো অনেক কঠিন খেলা, কিছুতেই কিছু হচ্ছে না। এই গেমে এভারেজ লেভেলে পৌঁছাতেও আমার হাজার বছর লেগে যাবে।”
তখন ইন্সট্রাক্টর হেসে বলেন, তুমি শুধু ১-২ মিলিমিটার দূরে রয়েছো বেস্ট প্লেয়ার হওয়া থেকে। টনি রবিনস তখন বললেন, “এই গলফ বল প্রতিবার নির্দিষ্ট হোল থেকে কমসে কম ৫০-৬০ মিটার দূরে গিয়ে পড়ছে।” ইন্সট্রাক্টর সাহেব হেসে বললেন, “বল হিট করার সময় তুমি যদি মাত্র ১-২ মিলিমিটার অন্য দিকে হিট করো, তাহলে বলটি ঠিক নির্দিষ্ট স্থানে গিয়েই পড়বে।” অর্থাৎ ইন্সট্রাক্টরের মতে টনি রবিনস সফলতার লেভেল থেকে মাত্র অল্প কিছু মিলিমিটার দূরেই দাঁড়িয়ে ছিলেন। আমাদের মধ্যে অনেকেই পরীক্ষার বিশাল সিলেবাস দেখে প্রথমেই হতাশ হয়ে পড়ে, অথচ সত্যি কথা হলো, আমাদের চেষ্টা ও সফলতার মাঝে কেবলই অল্প কিছু দূরত্ব বর্তমান।

(Source: freepik)
দ্রুততার সাথে সিলেবাস কভার করা, স্টাডি হ্যাকস, পড়াশুনার মোটিভেশন কিংবা পরীক্ষার আগের প্রিপারেশন- এরকম হাজারো প্রশ্নের উত্তর দিতে আমরা শিক্ষার্থীরা নিম্নোক্ত কয়েকটি পন্থা অবলম্বন করতে পারি-

এক. ৫ মিনিটে সময় ব্যবস্থাপনা


(Source: Dribbble)
দেখা যায়, পড়াশুনা শুরুর পূর্বেই আমরা একটা জিনিস নিয়ে খুব মাথা ঘামাই আর তা হলো এই সময় ব্যবস্থাপনার মারপ্যাঁচ। কোন সাবজেক্ট কতক্ষণ পড়বো, কোন চ্যাপ্টার প্রথমে পড়বো, কোনটা শেষে ধরবো- এগুলা চিন্তা করতে করতেই আমাদের অনেকটা মূল্যবান সময় চলে যায়। শেষে দেখা যায় কাজের কাজ কিছুই হয়নি। একটা রিসার্চে পাওয়া গিয়েছে যে, যতক্ষণ আমাদের মস্তিষ্ক বিভিন্ন কাজের চিন্তা-ভাবনার সাথে সমঝোতা করতে পারে না, ততক্ষণ আমাদের মস্তিষ্ক সুস্থির হতে পারে না।
তাই আমাদের উচিত সকালে ঘুম থেকে উঠামাত্র দিনের সকল দরকারি কাজ একটি কাগজে বা ডায়েরীতে লিখে ফেলা। এক্ষেত্রে ফোনের রিমাইন্ডার/টু ডু লিস্ট অ্যাপ ও ব্যবহার করা যেতে পারে। এসব টু ডু লিস্ট আমাদেরকে দিনের সকল কাজের একটা নির্দিষ্ট ধারণা দিতে পারবে এবং এর ফলে আমাদের মস্তিষ্ক আরো বেশি কর্মক্ষম হয়ে উঠবে। এর মাধ্যমে কাজের বিভিন্ন অগ্রাধিকার ও সেট করে ফেলা সম্ভব। কিন্তু এই সময় ব্যবস্থাপনার ক্ষেত্রে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ব্যপারটি হলো, পুরো কাজটি করতে ৫-১০ মিনিটের বেশি সময় নেয়া যাবে না। খুব দ্রুতই কাজের লিস্টটি বানিয়ে ফেললে আমরা দ্রুত পড়াশুনার কাজ শুরু করে দিতে পারবো।

দুই. প্রোক্রাস্টিনেশনের বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা !

ফেসবুকে মানুষের বায়ো ঘাটাঘাটি করলে যতটা প্রোক্রাস্টিনেটর পাওয়া যায়, বাস্তব জীবনে সংখ্যাটা কিন্তু আরো অনেক বেশি। আলসেমি বা শ্রমবিমুখ স্বভাবকে আধুনিক ইংরেজিতে বলা হয় প্রোক্রাস্টিনেশন। আলসেমিতে “কালকে থেকেই পড়তে বসবো” স্বভাব আমাদেরকে অনেকটাই পেছনে ফেলে দেয়। এক্ষেত্রে একমাত্র সমাধান হলো প্রোক্রাস্টিনেশনের বিরুদ্ধে রীতিমত যুদ্ধের ডামাডোল বাজানো। শুরুতে কিন্তু আমাদের অনেকেই ঠিক করি যে, আর নয় আলসেমি, কিন্তু বাস্তবে সে অনুযায়ী কাজ করা যে খুবই কঠিন !

(Source: thatawesomeshirt)

তিন. হিসাব মাফিক পড়াশুনা

পড়াশুনার অগ্রগতির হিসাব রাখতে হবে। কোন চ্যাপ্টার কতটুকু শেষ হয়েছে, সিলেবাসের কোন অংশে বেশি গুরুত্ব না দিলেই নয়- এইরকম বিষয়গুলোর প্রতি বিশেষ গুরুত্ব দিতে হবে। অনেক সময় দেখা যায়, কোনো বিষয় পড়তে গেলে প্রয়োজনীয় অনেক উপকরণ, দরকারি সহায়তা পাওয়া যায় না। আবার অনেক সময় বেশি রাত হয়ে গিয়েছে কিংবা পড়তে ইচ্ছা করছে না- এইরকম নানা বাহানার ফাঁদেও আমরা পা দেই। ফলস্বরূপ, আমরা ঐ বিষয়টিকে পরবর্তীতে পড়ার জন্য রেখে দিই। এমনটা করা থেকে বিরত থাকতে হবে। নিজ চেষ্টায় যতটুকু সম্ভব, ততটুকু পড়ার চেষ্টা করাটাই শ্রেয়।

চার. দেহযন্ত্রের যত্ন

শরীর নামক যন্ত্রটিতে পর্যাপ্ত জ্বালানী সরবরাহ করতে হবে। শরীর দুর্বল থাকা মানেই প্রোক্রাস্টিনেশনের দিকে অগ্রসর হওয়া। তুমি যদি অনেক ক্লান্ত থাকো অথবা পেটে যদি ক্ষুধার তাড়না থাকে, তুমি কিন্তু কিছুতেই পড়ায় মন দিতে পারবে না। আর যদি তুমি জোর করে পড়াশুনা চালিয়েও যাও, তবেও কিন্তু তোমার মস্তিষ্কে ঐ পড়ার স্থায়িত্ব খুব অল্প সময়ের জন্য হবে। এজন্য খেয়াল রাখতে হবে, দিনের কোনো বেলার খাবার যেনো বাদ না যায় এবং একই সাথে অতিরিক্ত পরিমাণে খাদ্যগ্রাসও যেন না হয়। নিজেকে সর্বদা জলযোজিত (hydrated) রাখতে হবে, কিছুতেই দেহে পানির অভাব ঘটতে দেয়া যাবে না। পড়াশোনার সময়ে প্রতি ৪৫ মিনিট পরপর পানি পান করা উচিত।

(Source: Weight expectations)

পাঁচ. হরেক জায়গায় পড়াশুনা

তোমার হয়তো উচ্চতর গণিত ভালো লাগে না। জৈব রসায়নের অতিকায় সব বিক্রিয়া দেখে তুমি ভীষণ ভয় পাও। এরকম ভীতিকর পরিস্থিতিও ঐসব বিষয়ের প্রতি আলসেমির জন্ম দেয়। এ থেকে পরিত্রাণের উপায় হচ্ছে, তুমি এইসব বিষয় নিয়ে ঘাঁটাঘাঁটি করার জন্য ভিন্ন কোনো স্থান বেছে নাও। বেডরুমের পড়ার টেবিলেই যে পড়াশুনা করতে হবে, তার কিন্তু কোনো বাধ্যবাধকতা নেই। বরং কোনো লাইব্রেরি, কফি শপ, বুক স্টোরের মত বিভিন্ন জায়গায়ও কিন্তু তুমি পড়াশুনার উদ্দীপনা পাবে।
এসব জায়গা চিরায়িত ক্লাসরুম কিংবা পড়ার টেবিলের চেয়ে ভিন্ন হওয়ায় তুমি কিন্তু সহজেই তোমার পড়াশুনার কাজটি সম্পন্ন করতে পারবে। বেঙ্গল বই কিংবা পিবিএস এর মত বুক স্টোর, নার্ডি বিন কফি হাউসের মত বইঘেরা কফি শপ কিংবা ব্রিটিশ কাউন্সিলের ছিমছাম লাইব্রেরির মত জায়গাগুলো কিন্তু পড়াশুনার জন্যও সহায়ক।

ছয়. অতিরিক্ত চাপ?

অনেক সময় দেখা যায়, কোনো একটা সময় আমাদের উপর দিয়ে পড়াশুনার অনেক চাপ যায়। টার্ম পেপার, অ্যাসাইনমেন্ট, ল্যাব, প্রেজেন্টেশন, টার্ম ফাইনাল, কুইজ সব একসাথে এসে হাজির হয়। এসব সময়ে সামান্য প্রোক্রাস্টিনেশনের জন্য আমাদের মারাত্মক মূল্য পরিশোধ করতে হতে পারে। তাই সপ্তাহের অন্তত একটি দিন আমাদের উচিত সব ধরনের সোশ্যাল মিডিয়া থেকে নিজেকে কিছুটা বিচ্ছিন্ন রেখে ভার্সিটি-কলেজ-স্কুলের বাড়তি চাপকে সামাল দেয়া।

(Source: Damiengaleon)

সাত. কখন পড়াশুনা করবো?

এই প্রশ্নের উত্তর হতে পারে সকালবেলা। এক রিসার্চে দেখা যায়, সকালে ঘুম থেকে উঠার পর আমাদের মস্তিষ্ক সবচেয়ে বেশি নির্ভার থাকে এবং এসময় যেকোনো বিষয় দ্রুতই বুঝে ফেলা সম্ভব। অন্য একটু সুবিধা হলো, সাধারণত সকালবেলায় ফেসবুক, ইন্সটাগ্রাম, হোয়াটসঅ্যাপের মত সোশ্যাল মিডিয়ায় মানুষের আনাগোনা কম থাকে। সেকারণে, সকালবেলা এসব মিডিয়াতে সময় নষ্ট করার সুযোগ ও থাকে না। অনেক সময় দেখা যায়, সকাল সকাল ক্লাস থাকে, যে কারণে খুব ভোরেই আমাদের ছুটতে হয় ভার্সিটি-কলেজের উদ্দেশ্যে। তাছাড়া, ক্লাসের বিরতিতে আমরা লাইব্রেরিতে গিয়ে নির্বিঘ্নে পড়াশুনা করতে পারি। সঙ্গে এমন কোনো বন্ধুকে নিয়ে যেতে পারি, যার কাছে পড়াশুনার নানা সহায়তা পাওয়া সম্ভব।

আট. কতক্ষণ পড়বো?

প্রকৃতপক্ষে এই প্রশ্নের নির্দিষ্ট কোনো উত্তর নেই। কেননা, কোন বিষয়ে ঠিক কতটুকু সময় দেয়া উচিত, সেই উত্তর শুধু তোমারই জানা উচিত। কোনো সাবজেক্টে বেশি সময় দেয়া লাগতে পারে, কোনোটায় কম। শুধু জেনে রাখা উচিত, প্রতি ১-১.৫ ঘণ্টা পড়ার পর পর ১০-১৫ মিনিটের বিরতি নেয়া উচিত। আমাদের দেহ রোবট নয় যে আমরা একটানা ৬-৭ ঘণ্টা পড়াশুনার ধকল কাটিয়ে উঠতে পারবো। যতক্ষণই পড়াশুনা করি না কেন, পড়াশুনার ফাঁকে ফাঁকে অবশ্যই বিরতি প্রয়োজন রয়েছে। পড়াশুনার মাঝে বিরতিতে কিছু খেয়ে নিতে পারো, হালকা হাঁটা চলা কিংবা বডিস্ট্রেচিং করে নিতে পারো। তাই বলে, ১ ঘণ্টা পড়াশুনা করে ২ ঘণ্টার বিরতি নিলে কিন্তু আবার হিতে-বিপরীত হয়ে যেতে পারে।
প্লাস্টিক সার্জনরা খুব সহজেই এবং নিমিষেই একটি কুৎসিত চেহারাকে সুন্দর করে দিতে পারে, তাই না? এখানে একটি মজার তথ্য দেয়া যাক- পৃথিবীতে সুন্দর মানুষগুলোর চেহারায় উপরের ঠোঁট থেকে নাকের দূরত্ব তাদের চোখের মাপের সমান হয়। অর্থাৎ তাদের উপরের ঠোঁট থেকে নাকের দূরত্ব আধ ইঞ্চি হলে তাদের চোখের প্রস্থ ও আধ ইঞ্চি হয়। এই আধ ইঞ্চি মাপ যদি একটু এদিক সেদিক হয়, তাহলে সেই ব্যক্তির সৌন্দর্য কমে যেতে থাকে। তাই প্লাস্টিক সার্জনরা তার রোগীদের চেহারায় খুবই ক্ষুদ্র একটু পরিবর্তন আনলেই ঐ ব্যাক্তির চেহারা নিমিষেই পাল্টে যায়। ঠিক এভাবেই, আমরা যদি আমাদের পড়াশুনার পদ্ধতিতে খুব সামান্য পরিবর্তন আনি, তাহলেই কিন্তু আমরা আয়ত্তে এনে ফেলবো পড়াশুনা ১০১ নামের কোর্সটি !  
তথ্যসংগ্রহ:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

0 মন্তব্যসমূহ