যদি জন লোক একটি কাজ দিনে সম্পন্ন করতে পারে, তবে জন লোক কাজটি কতদিনে করতে পারবে?
কিংবা একটা জিনিস ১০ টাকা ক্ষতিতে বিক্রি করা হলো। যদি সেটি টাকা বেশি মূল্যে বিক্রি করা হতো, তাহলে শতকরা কত টাকা লাভ হতো? জিনিসটি কত দামে কেনা হয়েছিল?
পর্যন্ত পড়ে মনে একটা প্রশ্ন ওঠা খুবই স্বাভাবিক। একটা গল্প বলার কথা অথচ হাইস্কুলের পাটিগণিতের অঙ্ক এখানে কেন? গল্পটা পুরোপুরি পড়ে ফেললে সব প্রশ্নের অবসান হবে আশা করছি!
সাল ১৮৫৫। সাবেক পাবনা বা বর্তমান সিরাজগঞ্জ জেলা শহর থেকে মাত্র সাত-আট মাইল দক্ষিণে কামারখন্দ উপজেলার তেঁতুলিয়া গ্রামে কৃষ্ণচন্দ্র চক্রবর্তী আর দুর্গা সুন্দরী দেবীর ঘরে জন্ম নেন যাদবচন্দ্র চক্রবর্তী। তাঁর হাতেখড়ি হয় তেঁতুলিয়া কালিয়া বাবুদেব পাঠশালায়। পরে ভর্তি হন কাওয়াকোলা স্কুলে। এরপর এম. স্কুলে, যা বর্তমানে বি.এল. সরকারী উচ্চ বিদ্যালয় নামে পরিচিত। ছয় ভাইবোনের মধ্যে সবচেয়ে বড় যাদবচন্দ্র চক্রবর্তী ছোটবেলা থেকেই ছিলেন অসাধারণ মেধাবী। তখনকার সময়ে মধ্যবৃত্তি নামের একটা পরীক্ষা হতো। তিনি সে পরীক্ষায় পুরো রাজশাহী বিভাগে প্রথম হন! এজন্য মাসিক চার টাকা হারে বৃত্তিও পেয়েছিলেন। ১৮৭৬ সালে এন্ট্রেন্স পাশ করেন প্রথম বিভাগে, মাসিক ১৫ টাকা বৃত্তিসহ। গণিতে কৃতিত্বের সাথে এম.. ডিগ্রি লাভ করে কলকাতা সিটি কলেজে অধ্যাপনা শুরু করেন।
কলকাতা সিটি কলেজে অধ্যাপনার সময়েই তিনি পাটিগণিতের একটি মানসম্মত বই থাকার প্রয়োজনীয়তা অনুভব করলেন। আর সেই চিন্তা থেকেই রচনা করা শুরু করলেন গণিতশাস্ত্রের অন্যতম শ্রেষ্ঠ বই “Arithmetic”, ১৮৯০ সালে বইটি প্রথম প্রকাশিত হয়।
খুব অল্প সময়ের মধ্যেই বাংলা, উর্দু, হিন্দিসহ বেশ কয়েকটি ভাষায় অনুবাদ হয়। তখন তিনি আলীগড় মুসলিম বিশ্ববিদ্যালয়ের পাটিগণিতের অধ্যাপক। বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রতিষ্ঠাতা স্যার সৈয়দ আহমদ তাঁকে নিজে পদে নিয়োগ দিয়েছিলেন। এমনকি কাছাকাছি একটা আবাসও ঠিক করে দিয়েছিলেন।
একটা সময়ে তাঁর রচিত পাটিগণিত বা বীজগণিত বই ছিল অবশ্যপাঠ্য
আলীগড় বিশ্ববিদ্যালয়ে অধ্যাপনাকালেই ১৯১২ সালে তাঁর বীজগণিত বইও প্রকাশিত হয়। যেটিও গণিতশাস্ত্রের অন্যতম শ্রেষ্ঠ সম্পদ। পরবর্তীতে তাঁর একটা জ্যামিতি বইও প্রকাশিত হয়। শুধু উপমহাদেশ নয়, ইউরোপের বড় বড় বিশ্ববিদ্যালয়েও তাঁর বই পড়ানো হতো।
এমন একটা সময় ছিল, যখন সিরাজগঞ্জ জ্ঞানদায়িনী হাইস্কুল, ভিক্টোরিয়া কিংবা রেলওয়ে স্কুলের ছাত্ররা অঙ্ক পরীক্ষার আগে যাদবচন্দ্র চক্রবর্তীর বাড়ির মাটি সম্মান করে পরীক্ষা দিতে যেত! এমনকি নাক উঁচু করে চলা ব্রিটিশরাও এই গণিতবিদকে ভক্তিভরে সম্মান করত। যারই ফলশ্রুতিতে ব্রিটিশ সরকার তাঁকে উপাধি দেয়গণিত সম্রাট
১৯০১ সালে যাদবচন্দ্র চক্রবর্তী সিরাজগঞ্জের ধানবান্ধিতে একটা বাড়ি নির্মাণ করেন। নিজ সন্তানদের এখানে রেখেই পড়ালেখার ব্যবস্থা করেছিলেন তিনি। আলীগড় বিশ্ববিদ্যালয় থেকে রিটায়ারের পর এখানে এসেই বাস করতেন তিনি। তাঁর বাড়ির সামনের রাস্তাটি বর্তমানে জেসি রোড বা যাদবচন্দ্র চক্রবর্তী রোড নামে পরিচিত। তবে সঠিক রক্ষণাবেক্ষণের অভাবে দখলদারের দৌরাত্মে তাঁর ভিটেবাড়ির তেমন কিছু আর অবশিষ্ট নেই এখন।
এই মহান গণিতবিদ শুধু গণিতেই সীমাবদ্ধ রাখেননি নিজেকে। সিরাজগঞ্জে থাকাকালীন সিরাজগঞ্জ মিউনিসিপ্যালের চেয়ারম্যানও নিযুক্ত হন। সিরাজগঞ্জ নাট্যভবনের প্রতিষ্ঠাতাও তিনি, যা বর্তমানে পৌর ভাসানী মিলনায়তন নামে পরিচিত। গ্রামের বাড়িতে একটি পাকা মন্দিরও নির্মাণ করেছিলেন তিনি। দেশ বিভাগের পূর্বে তিনি কলকাতায় চলে যান এবং সেখানেই ১৯২০ সালে পরলোকগমন করেন।
স্বাধীন বাংলাদেশ বা এর কাছাকাছি যাদের বয়স, তাদের প্রায় সবাই গণিত সম্রাট যাদবচন্দ্র চক্রবর্তীর নামটি শুনেছেন। একটা সময়ে তাঁর রচিত পাটিগণিত বা বীজগণিত বই ছিল অবশ্যপাঠ্য। আর হবেই না বা কেন! যাদবচন্দ্র চক্রবর্তী তাঁরপাটিগণিতবইটি লিখেছিলেন সপ্তম থেকে দশম শ্রেণীর শিক্ষার্থীদের জন্য। অথচ গণিতের একদম মূল বিষয়, যেমন সংখ্যাতত্ত্ব থেকে শুরু করে সবই আছে এই বইয়ে।
আমরা যাকে থিওরি বলি, তা যেমন আছে পর্যাপ্ত, ঠিক তেমনি উদাহরণ আর অনুশীলনীতেও আছে পর্যাপ্ত সমস্যা। এখনকার বইগুলোর সাথে যেটা মূল পার্থক্য।
অথচ খুব দুঃখের বিষয় যে, এত বিশাল একজন মানুষ যেন আজ আমাদের ইতিহাসের পাতা হতে বিলীন প্রায়! সম্রাট কাদের বলা হয়? যারা বিশাল সাম্রাজ্যের অধিপতি, মহাপরাক্রমশালী। গণিতশাস্ত্রে বাবু যাদবচন্দ্র চক্রবর্তী যেন ঠিক তাই। গণিতের সব ক্ষেত্রেই যার ছিল ধ্রুপদী বিচরণ। তাইতো যাদবচন্দ্র চক্রবর্তী একজন সম্রাট, গণিতের সম্রাট।