এইতো সেদিন তুমি একটা ন্যাদান্যাদা বাচ্চা ছিলে, নাক টিপলে দুধ বেরিয়ে যেত। দেখতে দেখতে কাঁধে ব্যাগ নিয়ে গুটিগুটি পায়ে স্কুলের দোরগোড়ায় পা রাখলে, নতুন নতুন বন্ধু, অনেক আনন্দ-খুনসুটি-খেলাধুলা, কতো কতো স্মৃতি! হঠাৎ ভাবলে কেমন অবাক লাগে না, কতো দ্রুত সময় পেরিয়ে যায়? এখন তোমরা যারা বয়ঃসন্ধিকালে আছো, চোখে হরেক রকম স্বপ্ন, কল্পনাও করতে পারবে না কতো দ্রুত এই দিনগুলো কেটে যাবে জীবন থেকে।
পড়াশোনা আর অনলাইনে ঘোরাঘুরি করে সময়গুলো পার করে দিচ্ছো অনেকেই। বিশ্বাস করো, এর বাইরেও অনেক কিছু করার আছে, জানার আছে! পৃথিবীটা অনেক বড়, পরীক্ষার সাজেশন আর অমুক খেলোয়াড় কত গোল করেছে এর খবর রাখার বাইরেও বিশাল একটা জগত আছে, দেখার আছে অনেক কিছু, আছে অনেক কিছু জানার। তাই বিশের দোরগোড়ায় পা রাখার আগেই করে ফেলো এই সাতটি কাজ, জীবনের অভিজ্ঞতার সঞ্চয়ে আর দশজনের চেয়ে এগিয়ে যাও এক ধাপ!
১. বিভিন্ন বিষয়ে দক্ষতা গড়ে তুলো
আমার অনেক বন্ধু-বান্ধব আছে যারা মাঝেমধ্যে আমাকে এসে বলে, “দোস্ত চল একটা কিছু করা দরকার। বাবা-মার টাকায় বসে বসে খাই এভাবে আর কতদিন? চলো এবার নিজের পায়ে দাঁড়াই!”আমি উৎসাহে টেবিলে ঘুষি মেরে বলি,
“ফাটাফাটি আইডিয়া! বল কি করবি?”
এই প্রশ্নটি তাদের উৎসাহে কেমন জল ঢেলে দেয়, কিছুক্ষণ মাথা চুলকে মিনমিন করে বলে, আসলেই তো! কি করা যায়?
আমি ছোট একটা দীর্ঘশ্বাস ছাড়ি। এত বছর পড়াশোনা করে আমরা এখনও একটা দক্ষতা গড়ে তুলতে পারিনি যেটি না পৃথিবীর কোন কাজে আসে, না সেটি দিয়ে কিছু আয় রোজগার করা যেতে পারে! এখন মানুষের ঘরে ঘরে কম্পিউটার, হাতে হাতে স্মার্টফোন, অনলাইনে কাজ করার অসংখ্য সুযোগ রয়েছে। পাওয়ারপয়েন্ট, এক্সেল, ভিডিও এডিটিং, গ্রাফিক্স ডিজাইনিং ইত্যাদি অনেক কিছু শিখে ফেলতে পারো ঘরে বসে ইউটিউবে ঘেঁটে ঘেঁটে টিউটোরিয়াল দেখে। এই দক্ষতাগুলো ভবিষ্যতে কত যে কাজে আসবে কল্পনাও করতে পারবে না এখন!
২. নতুন একটা ভাষা শেখো
নতুন ভাষা শেখার খুব মজার একটি ব্যাপার রয়েছে, শুধুমাত্র ম্যান্ডারিন ভাষাটি শিখেই তুমি পৃথিবীর একশ কোটি মানুষের সাথে গল্প করার সুযোগ পেয়ে যাচ্ছো! একটি ভাষার একদম অনন্য কিছু সৌন্দর্য থাকে, অনুবাদ করে সেই সৌন্দর্যটি কোনদিন রক্ষা করা যায় না, সেই ভাষাটি শিখে তুমি যখন তাদের আপন বুলিতে গল্প করবে তখন ভীষণ অবাক হয়ে দেখবে পৃথিবীটা কতো বিচিত্র!বর্তমানে চীনারা সারা পৃথিবীতে রমরমা বাণিজ্য করছে, তারা যখন দেখবে তুমি তাদের ভাষায় কথা বলতে পারো ব্যাপারটি যে তোমাকে চাকরি-বাকরির ক্ষেত্রে কতোটা অগ্রাধিকার দেবে তা কল্পনাও করতে পারবে না। ইউটিউবে ভাষা শেখার অসংখ্য চ্যানেল রয়েছে, স্প্যানিশ, জার্মান, ম্যান্ডারিন, জাপানিজ ইত্যাদি যেই ভাষা ইচ্ছে প্রতিদিন একটু একটু করে শিখে ফেলতে পারো তুমি!
(এই ব্যাপারে তোমাকে দারুণ সাহায্য করবে এই চমৎকার লেখাটি)
৩. ভালোবাসার জায়গাটিতে কাজ করো
তোমার হয়তো ফুটবল খেলা খুব পছন্দের, কিন্তু বাবা-মার “আমার সন্তান ডাক্তার ইঞ্জিনিয়ার হবে” এর চাপে পড়ে তোমার খেলোয়াড় হওয়ার ইচ্ছা বহু আগেই একদম মাঠে মারা গেছে। তাই বলে কি সব শেষ হয়ে গেছে? মোটেই না! হয়তো তোমার কণ্ঠ ভালো, কাজ করতে পারো খেলার ধারাভাষ্যকার হিসেবে। লেখার হাত ভাল হলে পত্রিকায় স্পোর্টস কলাম লিখতে পারো। ইঞ্জিনিয়ার হয়ে না হয় একটা ফুটবলের অ্যাপই বানিয়ে ফেললে! এখন থেকেই লক্ষ্য ঠিক করে কাজ শুরু করে দাও, পছন্দের ক্ষেত্রে কাজ করার সৌভাগ্য খুব কম মানুষের হয়, এই সুযোগ হাতছাড়া করবে কেন?৪. একটা কৃতিত্ব অর্জন করো
ধরো তুমি ইন্টারভিউতে গেলে, সেখানে জিজ্ঞেস করা হলো, “তোমার জীবনে কি কি অর্জন আছে বলো। কোন গুণটি তোমাকে আলাদা করবে অন্যদের চেয়ে?”দুঃখের বিষয় SSC এবং HSC এর সার্টিফিকেট ছাড়া আমাদের বেশিরভাগেরই “অর্জন” বলতে কিছু নেই! তোমার আশেপাশে সবারই GPA-5, সবাই A+ পাওয়া, তোমাকে আলাদা করে চেনানো যায় এমন কোন কৃতিত্ব কি আদৌ আছে তোমার? না থাকলেও সমস্যা নেই। এতদিন হয়নি, এবার হবে। জিনিসটি হতে পারে খুব সাধারণ কিছু- স্কুলের দৌড় প্রতিযোগিতায় তুমি প্রথম হয়েছিলে, গল্প লেখা প্রতিযোগিতায় তোমার লেখাটি প্রথম পুরস্কার পেয়েছে, ইউটিউবে তুমি মজার কিছু ভিডিও বানিয়ে ছেড়েছো সেগুলির কোনটি রাতারাতি এক লাখ ভিউ পেয়েছে! কত বিচিত্র উপায়ে কৃতিত্ব অর্জন করা সম্ভব, তবে আর বসে রইবে কেন?
৫. স্কুল-কলেজের বিভিন্ন ক্লাবে সক্রিয় হও
ক্লাবগুলোর ব্যাপারে অনেকের একটি নাক সিঁটকানো মনোভাব রয়েছে “এইসব ক্লাবে কিচ্ছু হয়না, ছেলেপেলে আড্ডাবাজি করে বাজে সময় নষ্ট করে!” এই ধারণাটি যে কত বড় ভুল সেটি কল্পনা করার মতো নয়। স্কুল-কলেজে অনেকরকম ক্লাব থাকে- বিজ্ঞান ক্লাব, বিতর্ক ক্লাব, এগুলোতে কাজ করে তোমার যে অভিজ্ঞতা অর্জন হবে, বিচিত্র অনেক কিছু শেখা হবে, একটি চমৎকার বন্ধু-বান্ধব সার্কেল গড়ে উঠবে সেটির কোন তুলনা হয় না।
একটি ভাল বই, ভাল মুভি জীবনের উপর কত গভীর রেখাপাত করতে পারে সেটি ভাবলে অবাক হতে হয়
ছোট্ট একটি উদাহরণ দেই, এই কিছুদিন আগে আমার বিতর্ক ক্লাবের সহপাঠীরা বিতর্ক করতে ইউরোপের নয়টি দেশ ভ্রমণ করে এসেছে! শুনে আমার বিশ্বাস হতে চায়না, কলেজে তারা যখন ক্লাবে কাজ করেছে আমি সেই সময়টিতে ঘরে বসে পড়াশোনা করে পরীক্ষায় হয়তো পাঁচ নম্বর বেশি পেয়েছি। কিন্তু তারা একটি গুণ রপ্ত করেছে সেটি হচ্ছে বিতর্ক,
এই একটি গুণের জোরে তারা নয়টি দেশ ঘুরে এসেছে, আমার বসে বসে দেখা আর নখ কামড়ানো ছাড়া কিছু করার নেই! তাই বিভিন্ন ক্লাবে যুক্ত থাকো, সক্রিয় হও, পরবর্তী জীবনে এই অভিজ্ঞতাগুলো কত যে উপকারে আসবে সেটি বলার মতো নয়।৬. অনেক অনেক বই পড়ো, মুভি দেখো
খুব চমৎকার একটি কথা রয়েছে- “A reader lives a thousand lives before he dies.”কি অসাধারণ একটি বিষয়! এই পৃথিবীটি এত বড় যে এক জন্মে আসলে গোটা জগতটি ঘুরে দেখা সম্ভব নয়, সেজন্য কয়েকবার জন্মানো প্রয়োজন! কিন্তু বই পড়ে বা মুভি দেখে সেই সুযোগটি তুমি ঘরে বসেই পেয়ে যাচ্ছো! একটি ভাল বই ভাল মুভি জীবনের উপর কত গভীর রেখাপাত করতে পারে সেটি ভাবলে অবাক হতে হয়। এ পি জে আব্দুল কালামের “Wings of Fire” অথবা বিখ্যাত “The Shawshank Redemption” যে কত মানুষের জীবনের মোড় ঘুরিয়ে দিয়েছে তার হিসেব নেই। তাই জীবনকে সমৃদ্ধ করতে, চিন্তা ভাবনায় ঋদ্ধ হতে গড়ে তোলো প্রচুর ভাল বই পড়ার এবং ভাল মুভি দেখার অভ্যাস।
৭. দেশকে জানো
মাতৃভুমি, জীবনের
চেয়ে
প্রিয়
এই
বাংলাদেশকে ঠিক
কতটুকু
চেনো
তুমি?
পৃথিবীর সবচেয়ে সুন্দরতম অনুভূতিটি হচ্ছে
মাতৃভূমির প্রতি
ভালোবাসা, এই
ভালোবাসাটিতে কোন
খাদ
নেই।
আমরা
যে
কি
অসম্ভব
সৌভাগ্যবান বাংলার
বুকে
জন্ম
নিতে
পেরে
সেটি
অনুভব
করতে
হলে
আমাদের
জানতে
হবে,
চিনতে
হবে
বাংলাদেশকে। বীরশ্রেষ্ঠ সাতজন
আছেন
জানি,
তাঁদের
অপূর্ব
আত্মত্যাগের গল্পগুলো কি
জানা
আছে
তোমার?
ছয়
ঋতুর
এই
অপূর্ব
দেশ,
কালবৈশাখীর দিগন্তজোড়া মত্ত
ঝাপটা,
আষাঢ়ে
অকূল
পদ্মার
বুক,
ত্রিশ
লক্ষ
শহীদের
পূণ্যরক্তে ভেজা
এই
পবিত্র
মাটির
প্রতিটি ঘাসের
কণায়
জমে
রয়েছে
অজস্র
গল্প,
অজানা
ইতিহাস,
সেগুলো
জানতে
হবে
তোমার।
অনেক
সম্ভাবনার, অনেক
ভালবাসার, অসম্ভব
গৌরবের
আর
দুঃসহ
আত্মত্যাগের অজস্র
গল্পের
চাদরে
মোড়া
আমাদের
এই
প্রিয়
মাতৃভূমি- একজীবনে যদি
আপন
ইতিহাসটিই না
জানলে,
তবে
গোটা
জীবনটাই যে
ব্যর্থ
হয়ে
যায়!
0 মন্তব্যসমূহ