ফরিদপুরের ছোট্ট একটা গ্রাম। ভগণডাঙ্গা নাম। কাকডাকা ভোর।
দূরে দেখা যাচ্ছে একটা রিক্সা এগিয়ে আসছে। রিক্সার চালকের বয়স হয়েছে। রিক্সা চালাতে কষ্ট হচ্ছে। বিন্দু বিন্দু ঘামের রেখাও দেখা যাচ্ছে। রিক্সায় কিন্তু মানুষ নেই। একটা গাছের চারা।
মানুষটা পরিশ্রম করে একটা গাছের চারা নিয়ে কোথায় যাচ্ছে? একটু পরেই মিলল সে প্রশ্নের উত্তর। রাস্তার এক পাশে অদ্ভুত মায়ার সাথে পুঁতে দিলেন তিনি গাছের চারাটা। কিন্তু কে এই শ্মশ্রুমণ্ডিত মানুষটি? কেনই বা এমন কাজ করছেন?
কাছে গিয়ে দেখা গেলো, ইনি তো ফরিদপুরের বিখ্যাত সামাদ চাচা! ষাটোর্ধ্ব মানুষটি পরিশ্রমে ক্লান্ত, কিন্তু তার চোখেমুখে খুশির আভাস দেখা যাচ্ছে। আরো একটি দিন তো তিনি গাছ লাগাতে পেরেছেন! প্রশ্ন আসে, কে এই সামাদ চাচা? কেন একজন সাধারণ রিক্সাচালককে একটা জেলার সবাই চেনে? উত্তর সেই গাছেই।

একজন বৃক্ষমানব:

ফরিদপুরের এই প্রৌঢ় মানুষটি গত আটচল্লিশ বছর ধরে প্রতিদিন অন্তত একটি হলেও গাছ লাগিয়েছেন। সেই ছোটবেলা থেকে শুরু, এখনো বিপুল উদ্যমে তিনি বৃক্ষরোপণ করেই চলেছেন! এখন পর্যন্ত এই মানুষটি সতেরো হাজারেরও বেশি গাছ লাগিয়েছেন!
সামাদ চাচার এই দারুণ কাজ চোখ এড়ায়নি এলাকাবাসীর। সেই থেকেই প্রবীণ এই রিক্সাচালককে সবাই চেনে বৃক্ষ সামাদ হিসেবেই। তার ভাষ্যমতে, গাছ না লাগালে নাকি তার ঘুম হয় না! একবার ভাবো তো, একজন মানুষ, যার দৈনিক আয় একশ টাকাও হয় না অনেক সময়- তিনি প্রতিদিন একটা করে গাছ লাগিয়ে পরিবেশ বাঁচাচ্ছেন। আর আমরা কী করছি?

সত্যিকারের সুপারহিরো:

ছোটবেলায় আমার শখ ছিল, যখন যেই ট্রেন্ড চলে, তার সাথে তাল মিলিয়ে চলা। তাতে নিজেকে অনেককুলভাবা যেতো! একদম ছোটবেলায় দেখতাম সবাই ব্যাগি প্যান্ট পরে ঘুরে বেড়াতো, আব্বুর সাথে বাজারে গেলে তাই প্রতিনিয়ত ব্যাগি প্যান্টের খোঁজে অস্থির হয়ে যেতাম! আর খেলতাম পোকেমন কার্ড, সবাই যাতে বলে- “আরে! আয়মান ছেলেটার তো অনেক Swag!”
একটু বড় হয়ে দেখলাম যে এসব আর কুল নয়, কুল হলো স্পাইক করা চুল নিয়ে ঘোরা। যেই ভাবা সেই কাজ, লেগে পড়লাম চুল স্পাইক করার মিশনে। এখনো মনে আছে, গোসল করে মাথায় টুপি পরে ঘুরতাম যাতে চুলগুলো স্পাইক করা থাকে! বিশ্ববিদ্যালয়ে উঠে দেখি আরেক কাহিনী। এখন ইংরেজিতে কথা বলা, ইংরেজি মুভি দেখে সেই নিয়ে বকবক করাটা অনেক কুল, তাই সেটা শুরু করলাম।
পড়ালেখা শেষ করে এখন বুঝতে পারছি, সত্যিকারের কুল আসলে কী। না, এতে কোন Swag নেই। বলছি সামাদ চাচার কথা। এই মানুষটি সত্যিকারের কুল, তিনিই আসল সুপারহিরো। বাস্তবের সুপারহিরোরা আলখেল্লা পরে পৃথিবী বাঁচায় না, একজন রিক্সাচালকও তার সাম্যর্থের সবটুকু দিয়ে গাছ লাগিয়ে পৃথিবী বাঁচাতে পারেন।
আমরা অবাক হয়ে তাকিয়ে ভাবলাম, কেমন মহামানুষ?

ডেইলি স্টার সামাদ চাচা:

সামাদ চাচার খবর এখন আর পৃথিবীর অজানা নয়। সোশ্যাল মিডিয়ার কল্যাণে অনেকেই এখন তাকে চেনেন। বাংলাদেশের শীর্ষ দৈনিকগুলোর একটি, The Daily Star এর ২৬ বছর পূর্তিতে সামাদ চাচাকে ঢাকায় এনে সংবর্ধনা দেয়া হলো। ভাগ্যক্রমে আমিও সেখানে ছিলাম, এমন একজন মাটির মানুষের সাথে কথা বলার সৌভাগ্য তাই হয়েছিল আমার।
দেখলাম, সামাদ চাচার মুখ ভার। তার মুখে হাসি নেই। সবাই জিজ্ঞেস করছে তাকে, কিছু লাগবে কি না, তিনি কিছু খাবেন কি না। তবুও তাকে চিন্তাগ্রস্ত লাগে। অবশেষে একসময় সত্য জানা যায়। উনি ঢাকায় এসে আজ একটা গাছও লাগাতে পারেননি, তাই তার মন খারাপ।
তৎক্ষণাৎ একটা সিদ্ধান্ত নেয়া হলো, সামাদ চাচাকে গাছের চারা এনে দেয়া হলো, তিনি মহাব্যস্ত হয়ে গাছ লাগালেন। তার মুখে হাসি ফিরে এলো। তিনি স্বস্তি পেলেন, একদিনের জন্যেও গাছ লাগানো মিস হলো না! আর আমরা অবাক হয়ে তাকিয়ে ভাবলাম, কেমন মহামানুষ?
সামাদ চাচার মত চার যুগ ধরে গাছ লাগানোর মত প্রায় অসম্ভব কাজ আমরা হয়তো কেউই পারবো না। কিন্তু আমরাও কিন্তু চাইলেই প্রতিদিন একটা করে ভালো কাজ করতে পারি। সেটা হতে পারে এলাকার বৃদ্ধ এবং দরিদ্র কোন মানুষকে একবেলা ভরপেট খাওয়ানো, কিংবা পথশিশুদের জামাকাপড় কিনে দেয়া! সবকিছুই করা সম্ভব, যদি তোমার সেই সদিচ্ছাটুকু থাকে।